কোরীয় উপদ্বীপে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কাছে বলে উত্তর কোরিয়া বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পিয়ংইয়ং ও ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা যুদ্ধংদেহি বক্তব্য থেকে তারা সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
আগে যা বাগাড়ম্বর বলে বাতিল করা হয়েছিল, জুনে উত্তর কোরিয়া দু’টি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের পর সেই দুঃস্বপ্ন তাৎপর্যপূর্ণভাবে অধিকতর বাস্তব রূপ নিতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর পিয়ংইয়ংয়ের প্রতিক্রিয়া থেকে সংকট আরো গভীর হয়েছে। উত্তর কোরিয়া মার্কিন মূল ভূখন্ডকে অকল্পনীয় অগ্নিসাগরে পরিণত করার হুমকি দিয়েছে।
এদিকে পিয়ংইয়ং একটি আইসিবিএমের মাথায় ক্ষুদ্রাকৃতির পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র স্থাপন করতে সক্ষম বলে এক মার্কিন গোয়েন্দা মূল্যায়নে মন্তব্য করার পর এর জবাবে এক টেলিভিশন ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে উত্তর কোরিয়া এমন আগুন ও ক্রোধের শিকার হবে যা বিশ^ কখনো দেখেনি।
ট্রাম্পের হুমকি অস্বীকার করে ২৯ আগস্ট উত্তর কোরিয়া জাপানের উপর দিয়ে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। যার ফলে জাপান সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করে। এ ভাবে কিম জং-উনের সামরিক অভীপ্সার তাৎপর্যপূর্ণ বিস্তৃতি ঘটে।
৬ সপ্তাহেরও কম সময় পর উত্তর কোরিয়া তার ষষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। দেশটি এটিকে দূর পাল্লার অত্যাধুনিক হাইড্রোজেন বোমা বলে আখ্যায়িত করে। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হুমকির সম্মুখীন হলে ভয়াবহ সামরিক জবাব দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়।
উত্তেজনার আরো বিস্তৃতি ঘটিয়ে উত্তর কোরিয়া এ মাসে আবার জাপানের উপর দিয়ে আরেকটি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিম জং-উন আর বেশিদিন সরে থাকতে পারবেন না বলে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেয়ার পর উত্তর কোরিয়া তাকে যুদ্ধ ঘোষণা বলে আখ্যায়িত করে এবং বলে যে মার্কিন জঙ্গি বিমান গুলি করে নামানোর অধিকার তাদের আছে।
গুয়ামের উপর হামলা
গুয়ামের ২১০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রমের মত যথেষ্ট পাল্লা উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আছে। যদিও সেগুলোার সঠিক ভাবে আঘাত হানার সক্ষমতা এবং পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র রি-এন্ট্রিতে টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
পিয়ংইয়ং গুয়ামকে লক্ষ্যবস্তু করতে আগ্রহী হতে পারে এ কারণে যে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কোনো মার্কিন সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় কোরীয় উপদ্বীপে স্থল সৈন্য পুনঃসরবরাহ করার জন্য সেখানকার সামরিক, বিমান ও নৌ স্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পিয়ংইয়ংয়ের দাবি সত্তে¡ও বিশ্লেষকরা মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনিবার্য পাল্টা জবাবের প্রেক্ষাপটে বিনা উস্কানিতে গুয়ামের উপর হামলার সম্ভাবনা একেবারেই অসম্ভব।
জাপানের ডায়টো বুনকা বিশ^বিদ্যালয়ের আর্ন্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গ্যারেন ম্যালয় বলেন, উত্তর কোরিয়া যদি গুয়ামের উপর কোনো ধরনের হামলা চালায় তাহলে রেডলাইন অতিক্রম করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তা যুদ্ধ পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে। তিনি বলেন, যদি তারা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং বিশেষ করে তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে আমার ধারণা যে যুক্তরাষ্ট্র তাহলে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনায় লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে পারমাণবিক হামলা চালিয়ে জবাব দেবে অথবা এমন ভয়াবহভাবে প্রচলিত হামলা চালাবে যার পরিণতি একই হবে।
কত লোক ঝুঁকির সম্মুখীন?
উত্তেজনা কিভাবে যুদ্ধে রূপ নিতে পারে এবং তা উপদ্বীপ ও জাপানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ধ্বংস করতে পারে, বিশ্লেষকরা তার কিছু দৃশ্যকল্প প্রণয়ন করেছেন।
কোনো কোনো হিসাব অনুযায়ী প্রচলিত যুদ্ধে ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। তবে এ প্রাণহানির সংখ্যা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে যদি উভয়পক্ষ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে।
তিনটি অত্যন্ত সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প হচ্ছেঃ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সীমিত পূর্ব -নিরোধক হামলা, উত্তর কোরিয়া কর্তৃৃক প্রথম হামলা এবং অপ্রধান সংঘর্ষ হঠাৎ করেই ব্যাপক সার্বিক যুদ্ধে রূপ লাভ করা।
ট্রয় বিশ^বিদ্যালয়ের সিউল ক্যাম্পাসে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ড্যানিয়েল পিংকস্টোন বলেন, বিশ^াস করার সামান্যই কারণ আছে যে এ তিনটি দৃশ্যকল্পের কোনো একটির ফলাফল ধ্বংসকান্ড ছাড়া আর কিছু হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কি উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণ করবে?
পিংকস্টোন দি টেলিগ্রাফকে বলেন, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান সক্ষমতা লাভের বিষয় বিবেচনা করে তা দমনের জন্য ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব-নিরোধক হামলার কথা বিবেচনা করেছিল। কিন্তু সে সময় তারা এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়। আমি মনে করি এখনকার দিনে এ রকম হামলা চালানো আরো কঠিন হবে।
তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়া তাদের সম্পদ ছড়িয়ে রাখতে শিখেছে, তারা সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করছে এবং এ সব লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিহ্ন করা অত্যন্ত কঠিন।
আরো কথা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার সকল সামরিক স্থাপনাই চিহ্নিত না হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে । অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য রাস্তায় ভ্রাম্যমান ট্রাক্টরের উপর স্থাপিত নিক্ষেপক যানগুলো উত্তর কোরিয়ার সকল অস্ত্র চিহ্নিত করা কঠিন করেছে।
কূটনৈতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করা কঠিন হবে। পিয়ংইয়ংয়ের প্রধান মিত্র চীন ও রাশিয়ার আছে ভেটো ক্ষমতা। অন্যদিকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এ ধরনের হামলার বিরোধিতা করতে পারে যেহেতু তার তাৎক্ষণিক পাল্টা জবাবের ধাক্কাটা তাদের উপরই পড়বে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যদি আত্মরক্ষার যুক্তিতে একতরফা পদক্ষেপ নেয় তখন পিয়ংইয়ং তার দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কিছু মনে করবে না। পিংকস্টোন বলেন, তারা এটাকে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ হিসেবেই দেখবে এবং তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস ঠেকাতে তাদের কাছে যা কিছু আছে তার সবই ব্যবহার করবে। আর সে কারণেই আমি মনে করি রোগমুক্ত হওয়ার জন্য প্রথম মার্কিন হামলা রোগের চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
উত্তর কোরিয়া যদি প্রথম হামলা করে?
দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প হচ্ছে উত্তর কোরিয়া যদি প্রথম হামলা করে। সে তা করতে পারে যদি মনে করে তার শত্রæরা হামলার পরিকল্পনা অথবা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। একটি বিশ^াসযোগ্য ধারণা যে উত্তর কোরীয় স্¦ৈরশাসক কিম জং-উন ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বা বাধ্য হয়ে প্রবাস জীবন গ্রহণ করার চেয়ে লড়াই করাকে বেছে নেবেন যদি তা ব্যাপক মৃত্যু বা ধ্বংসের কারণ হয় তবু।
৩৫ মাইল দূরবর্তী ১ কোটি লোক অধ্যুষিত সিউলের দিকে পিয়ংইয়ং আনুমানিক ১০ হাজারটি আর্টিলারি পিস ও রকেট লাঞ্চার তাক করে রেখেছে। উত্তর কোরিয়া অসামরিকীকৃত অঞ্চলে মাটির নীচ দিয়ে খোঁড়া সুড়ঙ্গপথে দক্ষিণ কোরিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করতে পারে। সাবমেরিনে করে স্থল কমান্ডো ইউনিট পাঠাতে পারে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুপ্রবেশ করা হাজার হাজার ¯িøপার এজেন্টকে সক্রিয় করতে পারে।
মার্কিন সমর পরিকল্পকরা মনে করেন যে উত্তর কোরিয়া সংখ্যাধিক্যতার জোরে প্রথমেই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার সশস্ত্র সৈন্য সংখ্যা ৬ লাখ ৬৬ হাজার, সে দেশে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন আছে ২৮ হাজার। বিপরীতে উত্তর কোরিয়ার ১০ লাখ পুরুষ ও নারী সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
যদিও উত্তর কোরিয়ার সৈন্যসংখ্যা বেশী কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা পিছিয়ে আছে। সামরিক পরিকল্পকরা মনে করেন যে ৪ দিনের তুমুল যুদ্ধের পর উত্তরের শক্তি থিতিয়ে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র উত্তরের কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সক্ষমতার উপর ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র চালাবে , অন্যদিকে কিম জং-উন ও ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন এ আশায় যে তাদের মৃত্যু উত্তর কোরীয় সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে।
এ বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করেছিল যে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যাকারী সিল টিম আটক ও হত্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে।
উত্তর কোরিয়া কি ডবিøউএমডি ব্যবহার করতে পারে?
অধিকাংশ যুদ্ধ পরিকল্পকদের ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অনিবার্য পরাজয়ের মুখে উত্তর কোরিয়া কি করবে? তারা কি পরবর্তী পর্যায়ে প্রচলিত যুদ্ধের দিকে যাবে?
উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। বহু বিশ্লেষক মনে করেন যে দেশটি ক্ষেপণাস্ত্রের যুদ্ধাস্ত্রে সংযাজনের উপযুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির অস্ত্র সংযোজনের ক্ষমতা অর্জন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে সৈন্য সমাবেশ বা বেসামরিক কেন্দ্রগুলো লক্ষ্য করে তারা স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারে।
উত্তর কোরিয়ার কাছে রাসায়নিক অস্ত্রের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মজুদ আছে যার মধ্যে কিছু অস্ত্র কামানের গোলার দ্বারাও নিক্ষেপ করা যায়। পিয়ংইয়ং জীবাণু ও রোগজীবাণুগত অস্ত্রের উন্নয়ন করেছে বলে খবরের সত্যতা এখনো সমর্থিত হয়নি।
গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার উত্তর কোরিয়া জন্য ভয়ংকর পাল্টা জবাব নিয়ে আসবে।
যুদ্ধের সর্বপ্রধান দৃশ্যকল্প কী হতে পারে?
পিংকস্টোনের মতে, তৃতীয় দৃশ্যকল্পই কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের প্রধান পথ হতে পারে। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, সব চেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে কোনো দুর্ঘটনা, কোনো ভুল হিসেব বা কোনো ভুল বোঝাবুঝি যা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। যেমন, উত্তর কোরিয়ার কোনো একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ভুল হয়ে গেল ও তা দক্ষিণ কোরিয়ায় রওনা হল। দক্ষিণ কোরিয়া তৎক্ষণাৎ এটাকে হামলা বলে মনে করবে যা দু’দিকেই উত্তেজনার বিস্তার ঘটাবে।
একই ভাবে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ায় কিছু নতুন যৌথ মহড়াকে তার উপর হামলার পূর্ব প্রস্তুতি বলে ব্যাখ্যা করতে ও তার জবাব দিতে পারে। তিনি বলেন, উভয়পক্ষই চুলের উপর রয়েছে । বিপুল প্রাণহানি ও অপরিমেয় ধ্বংসকান্ড ঘটানোর জন্য ভুল পদক্ষেপ নিতে খুব দেরী নাও হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন