শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

তৈরী পোশাক খাতে অশনি সংকেত

| প্রকাশের সময় : ১৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বেসরকারী উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা দেশের তৈরী পোশাকখাতে নজিরবিহীন মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বমন্দার সময়ও তৈরী পোশাক খাত এতটা নেতিবাচক ধারায় যায়নি। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এবং দেশের মোট রফতানী আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের যোগানদাতা এই খাতের মন্দা মানে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হওয়া। চলতি অর্থবছরে তৈরী পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি ০.২০ ভাগ যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানী খাতে যখন নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের পোশাক রফতানীখাতে ডাবল ডিজিটের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের ট্রাডিশনাল রফতানী বাজারে বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অ্যাপারেল বাজার ক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে দ্রুত উপরে উঠছে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের তৈরী পোশাক রফতানীর প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ, যা চলতি অর্থবছরে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌছবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই ভারতের কাছে বাংলাদেশ তার অবস্থান হারিয়েছে। তৈরী পোশাক রফতানীর বাজার সম্প্রসারণে ভারত সরকার ৬ হাজার কোটি রুপির প্রণোদনা ঘোষনা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা জিইয়ে রেখে দেশের শিল্পবিনিয়োগ ও রফতানীখাতকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
সাভারে রানাপ্লাজা ট্রাজেডির নেপথ্যে রয়েছে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রচ্ছন্ন হাত। একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে হাজার হাজার শ্রমিককে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ভবন ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানী বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলের ষড়যন্ত্রের যোগসাজশ কোন নতুন ঘটনা নয়। রানা প্লাজা ধসের পর সেই সুযোগ সন্ধানী চক্র নতুন ফাঁদ হিসেবে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর উপর নানা ধরণের শর্ত চাপিয়ে দেয়। অ্যাকর্ড-এলায়েন্স নামের তৈরী পোশাক ক্রেতাদের জোট অনেকটা জগদ্দল পাথরের মত বাংলাদেশের তৈরী শিল্পের উপর চেপে বসে। গত কয়েক বছরে এই এদের তৎপরতা বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অ্যাকর্ড-এলায়েন্স নানা ধরনের শর্ত আরোপ করলেও তারা পোশাকের ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি বা বাজার সম্প্রসারণে কোন ইতিবাচক ভ’মিকা নেয়নি। এ সময়ে শুধুমাত্র ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরে সহস্রাধিক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের তৈরী পোশাক রফতানী নিয়ে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্বেগ প্রকাশিত হলেও সে সময়কার এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমইএ’র নেতাদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলেই বেশী তৎপর দেখা গেছে। অথচ দেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য এসব বণিক সংগঠন কার্যকর ভ’মিকা রাখতে পারত। প্রকারান্তরে তারা যেন ভারতকে বাজার দখলের সুযোগ করে দিয়েছে।
একদিকে ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের ফানুস উড়াচ্ছে অন্যদিকে প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোতে নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমে সংকটজনক অবস্থায় উপনীত হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে প্রায় আটবছর ধরে। তৈরী পোশাক রফতানী এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স দিয়ে অর্থনীতির চাকা মোটামুটি সচল থাকলেও এ দুই প্রধান খাতেই এখন বড় ধরনের ভাটার টান। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে চীনের তরফ থেকে কয়েক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের বেশ আশাব্যঞ্জক প্রস্তাব ও চুক্তি সম্পাদিত হলেও চুক্তি অনুসারে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থছাড়ের গতি অত্যন্ত মন্থর বলে জানা যায়। অন্যদিকে ভারতের কাছ থেকে কঠিন শর্তে উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর গত ৭ বছরে ৩০০ কোটি ডলারের বিপরীতে অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ৩৬ কোটি ডলার। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে সম্প্রতি ভারতের সাথে আরো সাড়ে৪ বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ইতিপূর্বে বিশ্বব্যাংকের সাথে সম্পাদিত সহজশর্তের ঋণচুক্তিগুলো ও এখন বর্ধিত সুদহারের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণে যেখানে সুদহার ছিল শুন্য দশমিক .৭৫ ভাগ সেখানে একলাফে ২ শতাংশ বা ১৬৬ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশের সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক রফতানীখাতকে একটি অবশ্যম্ভাবি ঝুঁকির মধ্যে রেখে তথাকথিত বৈদেশিক ঋণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। দেশের তৈরী পোশাক কারখানা ও পোশাক বাজার রক্ষার্থে প্রথমেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জিইয়ে রেখে অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। বিশেষত: তৈরী পোশাক খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনাময় খাতকে ঝুঁকিমুক্ত করতে, অ্যাকর্ড-এলায়েন্সসহ অ্যাপারেল রফতানীখাতের সংস্কারের কাজে মূলত: বিজিএমইএ এবং সরকারকে সমন্বিত শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার রক্ষায় কারখানার সংস্কার দাবির পাশাপাশি দেশের আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তার অভাব ও গণতন্ত্রায়ণের চ্যালেঞ্জ কাজ করছে। এসব বিষয় উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন