দেশের বর্ষীয়ান আলেম, হাটহাজারী বড় মাদরাসার মুহতামিম ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা আহমদ শফী হাটহাজারী মাদরাসার বার্ষিক সম্মেলনে আসলে কী বলেছেন, তা অনেকেই শুনেননি। যারা শুনেছেন, তাদের অনেকে তার কথার মর্ম বোঝেননি। আর অনেকে শুনলেও খন্ডিতভাবে শুনেছেন। আগে পরে সব না শুনে ‘চিলে কান নিল’ এর মতো কানে হাত দিয়ে না দেখেই চিলের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছেন। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু ঠেকেছে ওসব চোখকানা নারীবাদি ও একপেশে বুদ্ধিজীবিদের যারা দেশব্যাপী সাম্প্রতিক শিশু, বালিকা ও নারী ধর্ষণ এবং হত্যার মহামারীতেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। সুবর্ণচরের যে মা ১০ নরপশুর বর্বরতার শিকার তার ব্যাপারেও রহস্যময় নিরবতায় ডুবে থাকা অসুস্থ মনের লোকেরা আল্লামা শফীর কথায় যারপরনাই হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এমন সব মন্তব্য করছেন যা বক্তা ও ফেইসবুকারের মধ্যকার দিগন্তপ্রমাণ দূরত্বের সাথে যায় না। যারা আল্লামা শফীকে ‘ত্বলাবুল ইলমি ফারিদাতুন’ হাদীস শোনাচ্ছেন, তাদের এ কাজটি আরেকদলের কাছে ছোট শিশুর হাতিকে দাঁত দেখানোর মতই মনে হচ্ছে। উভয় পক্ষের মন্তব্য ও যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দেখে লোকে হাঁসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না।
আসলে দেশে কোনো ইস্যু না থাকলে কিছু লোক নন ইস্যুকে ইস্যু বানায়। এতে তারা মজা পায়। যেমন, উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার প্রকৃতিগত আকর্ষণকে তিনি একবার তেঁতুলের সাথে উপমা দিয়েছিলেন। যা পশ্চিমা বিজ্ঞানীরাও জার্নাল ও ম্যাগাজিনে ব্যাখ্যা করার সময় নর-নারীর নৈকট্যে শারীরিক পরিবর্তনের রসায়ন সম্পর্কে জীবনভর বলে এসেছেন। কিন্তু যত দোষ নন্দ ঘোষের মত একদল মানুষ আল্লামা শফীকে পেয়ে বসেছিলেন। অনেকে নিজের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ঢাকার জন্য কথায় কথায় ‘তেঁতুল হুজুর’ নামের জিগির তুলতেন। এদের অনেকেই এখন ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার দল ও জোটের সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন, কেউই আর আল্লামা শফীকে তেঁতুল হুজুর না বলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে আল্লামা শফীকে কটাক্ষ করা যাবে না।
হুজুর আসলে কী বলেছেন, কোন অর্থে বলেছেন তা জেনেই মন্তব্য করা উচিত। তবে, হুজুরের বয়স ৯৫ পার হওয়ায় নিঃসন্দেহে তার কথাবার্তায় কিছু অসতর্কতা এসেছে। যেজন্য বিগত কয়েক বছর ধরে তার নানা আচরণ, বক্তব্য ও মন্তব্যে বিতর্ক বা প্রশ্নেরও জন্ম হচ্ছে। যা নিয়ে হুজুরকেও একাধিকবার ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য দিতে হয়েছে। তার ভক্ত অনুসারীদের বহু বাক-বিতন্ডা চালাতে হয়েছে। যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে হুজুরকে ডিফেন্ড করতে হয়েছে। এসবের সহজ সমাধান হচ্ছে হুজুরের বক্তব্য কোনো মুখপাত্রের দ্বারা উপস্থাপন করা। যিনি বর্তমান সময়, পরিবেশ ও সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবগত। বাক্য প্রয়োগ ও শব্দ চয়নে দক্ষ, পরিপক্ষ।
যেখানে দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজ নানা অবক্ষয়ের নির্মম শিকার, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন ইত্যাদি তাদের উঠতি বয়সে একটি মানসিক ডিজঅর্ডার বা নেশায় পরিণত হয়েছে। পোপ তার ঢাকা সফরের সময় স্মার্ট ফোনের তুলনায় বাবা-মাকে বেশি সময় দেওয়ার জন্য বলে গেছেন। সারা বিশ্বে এ আহ্বান ছড়িয়ে পড়লেও কোনো প্রগতিশীল বা মুক্ত চিন্তার লোক এ নিয়ে হ্যাঁপা বাধায়নি। কিন্তু একই ধরনের কথা যখন কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্ব বলেন, তখন তাকে নিয়ে হৈ চৈ বাধানোর লোকের অভাব হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা হুজুরকে খুব মন্দ বলছেন, তারা কি লক্ষ্য করেন না যে, আল্লামা শফী দেশের কওমী মাদরাসাসমূহের সম্মিলিত বোর্ড আল হাইয়াতুল উলিয়া’র প্রধান। আর তার আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার মেয়েরা দাওরায়ে হাদীস পড়ছে। তারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে মাস্টার্সের মান পাচ্ছে। যা আল্লামা শফী নিজেই সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছেন। এখানে তিনি কী করে নারী শিক্ষার বিরোধিতা করতে পারেন? তিনি এটাও জানেন যে, দেশের আলীয়া মাদরাসাগুলোয় হাজার হাজার নারী দীনি উচ্চশিক্ষা লাভ করছে। শরীয়তের পাবন্দি করে হাজারো মেয়েরা আধুনিক শিক্ষা লাভ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হচ্ছে। যারা চরম বৈরি পরিবেশেও পর্দা ও আত্মসম্মান রক্ষা করেই এ সমাজে মানবতার সেবায় নিয়োজিত আছে। ঢাকায় এখন একাধিক হসপিটাল এমন আছে, যেখানে চিকিৎসা শাস্ত্রের সকল বিভাগে পরহেজগার ও শরয়ী পর্দাবিশিষ্ট নারী চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ও সার্জন পর্যন্ত আছেন। এসব বিভাগ থেকে দেশের সব ধরনের ওলামা-মাশায়েখ ও উচ্চ পরহেজগার লোকেদের স্ত্রী-কন্যারা নিশ্চিন্তে উপকৃত হচ্ছেন। এতে বোঝা যায়, হুজুর নারীদের উচ্চশিক্ষাকে অস্বীকার করেননি। তিনি পরিবেশগত অবক্ষয়ের কথা বলেছেন।
ইতোমধ্যে আমরা হুজুরের বয়ানের পূর্ণ বিবরণ ব্যাখ্যাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠ করেছি। এতে হৈ চৈ করার মতো তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, ইসলাম ও মুসলমানদের অতীত যাদের জানা আছে, নিঃসন্দেহে তারা জানেন যে, একেবারে উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের থেকে সাহাবীয়া হয়ে তাবেঈ, তাবে তাবেঈ নারী ব্যক্তিত্ব অনেক পাওয়া যায়। যারা কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্যের দিকপাল ছিলেন। ইসলামের দেড়হাজার বছরের কোনো শতাব্দীই এমন কীর্তিমতি নারী প্রতিভা থেকে খালি নয়।
ইংরেজ আমলে ভারতীয় সামাজিক নানা প্রথার প্রভাবে মুসলমানরাও নিজ ধর্মের নারীদের প্রতি বেশ সীমালঙ্ঘন করতে শুরু করে। হাক্কানী আলেম ও পীর-মাশায়েখরা নারীদের বিজাতীয় নিষ্পেশন থেকে মুক্তি দেন। তাদের ওপর ফরজ পরিমাণ দীনি শিক্ষা প্রদানের সুব্যবস্থা করেন। যে জন্য ভারত বর্ষের কোটি কোটি মুসলিম নারী যখন সরকারের অবহেলায় অক্ষর জ্ঞানহীন ছিলেন, তখন আলেম ও পীর-মাশায়েখদের চেষ্টায় এদের সবাই আবার কোরআন শরীফ পড়তে জানতেন। জীবনে চলার প্রয়োজনীয় শরীয়তি বিধি-বিধান জানতেন। ইসলামই বিশ্বে সর্বপ্রথম নারীদের সুস্থ পরিবেশে জীবনের সকল অঙ্গনে, জ্ঞান সাধনায়, উন্নত জীবন লাভের প্রচেষ্টায় উৎসাহিত করেছে। ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে যে, শিক্ষিত মা মানেই শিক্ষিত জাতি। এ নিয়ে উল্টো মন্তব্য বা বিতর্ক খুঁজে বেড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর ইসলামের সপক্ষে দেশে যারা নানা বৈরিতা সত্তেও মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন তাদের জন্য সমস্যা হয় এমন কোনো কথা যেন অসাবধানতা বশতও কেউ না বলেন। সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। উপস্থাপনের ত্রুটিতে কিংবা বক্তব্যের সরলতায় একটি ভালো কথাও সমালোচনার যোগ্য হয়ে যায়। নাস্তিকতা ও ধর্ম বিদ্বেষের যুগে দীনের বাণী প্রচারেও হেকমতের প্রয়োগ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে শতগুণ বেশি জরুরী। দেশের অসংখ্য ওলামা-মাশায়েখ তাদের এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করে থাকেন যে, হুজুরকে তার পরিমন্ডলে দরস-তাদরীস, ওয়াজ-নসীহত ইত্যাদিতে নিমগ্ন রাখা এসময় উত্তম। উন্মুক্ত জনসমাবেশে জাতীয় পর্যায়ের সভা-সমিতিতে বিশেষ করে মিডিয়ার মুখোমুখি তাকে দায়িত্বপূর্ণ আলোচনায় সামনে না রেখে একজন যোগ্য মুখপাত্রের সহযোগিতা নেওয়ায় এ মুহূর্তে সর্বোত্তম।
বয়স মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। বিশেষ করে সময়ের ব্যবধান তার মন-মানসিকতার সাথে না থেকে বহুদূর এগিয়ে যায়। রাষ্ট্র ও সমাজের, অর্থনীতি ও পরিবেশের বাস্তবতায় বহু মাসআলাতেও সম্ভাব্য শিথিলতা কিংবা ছাড় এসে যায়। অতি প্রবীণ একজন মানুষ তখন নিজ পরিসরে ঘরোয়া কথা বার্তায় ফিট থাকলেও মুক্ত আকাশে, ফাস্ট মিডিয়ায় তার সংক্ষিপ্ত বাক্য ও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ মন্তব্য বহু মত ও মনান্তর তৈরি করতে পারে। যেজন্য সংশ্লিষ্টদের নানা অঙ্গনে বহু ঝক্কি পোহাতে হয়। জলন্ত জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এসব যারা ফেইস করেন, তারাই বুঝবেন। অতএব, প্রায় শতায়ু এ মুরব্বী নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সমষ্টিকে নিজ মুখপাত্র বানিয়ে সুচিন্তিত ও নিখুঁত হেদায়াত দিলে সবারই মঙ্গল। গুটিকয় লোকের ভুল সিদ্ধান্ত, বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্বের চিন্তা ও ভ‚মিকাকে বদনাম করা কিংবা তার ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বক্তব্য অথবা এ জাতীয় নানা উপসর্গ তার ব্যক্তিত্বের যেমন ক্ষতি করতে পারে, তেমনই ইসলাম নিয়ে যত মানুষ এদেশে কঠিন বাঁধা বৈরিতা মোকাবেলা করেও কাজ করে যাচ্ছেন, অহেতুক তাদের চলার গতিকে বাধাগ্রস্ত ও আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। অতএব, সতর্কতা ও বাস্তবতার পূর্ণ উপলব্ধির বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন