মামলা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা উপেক্ষা করে আগামীকাল দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় হযরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছানোর কথা রয়েছে তার। দলের প্রধানের ফিরে আসার সংবাদেই দেশব্যাপী উজ্জীবিত হয়ে ওঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরেই খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাবে। দেশে ফিরে খালেদা জিয়া দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, আন্দোলন-সংগ্রামসহ অনেক বিষয়েই রূপরেখা ও কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে মনে করছেন তারা। নেতাকর্মীরা বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। যার মাধ্যমে আগামী দিনের রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি নির্ভর করবে। সরকার প্রস্তাব মেনে নিলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে জাতীয়তাবাদী দলটি। অন্যত্থায় রাজপথমুখী হওয়ার চিন্তা করা হবে বলে দলের সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন। বিএনপি প্রধানের নির্বাচন এবং আন্দোলন যে কোন ঘোষণার জন্য মাঠে থাকতে প্রস্তুত রয়েছেন তারা। এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরে আসছেন এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ কাজ করছে। তিনি বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সবসময় নির্বাচন ও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। বেগম খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবকিছুই জানেন। তিনি সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিবেন। এছাড়া নেতাদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ও কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, সহায়ক সরকার ও নির্বাচনকালীন রূপরেখা নিয়ে সরকার যদি চেয়ারপারসনের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে পরবর্তী করণীয় নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের বড় অংশই বলছেন, দাবি নিয়ে রাজপথমুখী হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। সে ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচিই দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এর আগে সহায়ক সরকারের প্রস্তাবের পক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হবে। এ নিয়ে ২০-দলীয় জোট ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট নাগরিক, কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শও নেবে বিএনপি। জানা যায়, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি নিয়ে ‘মাঠ গরম’ করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে বিএনপি জোটের। আগামী নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির বার্তা দেশে-বিদেশে পৌঁছে দেওয়া হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সভা-সমাবেশের নির্বাচন প্রস্তুতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার আন্দোলনের বার্তাও থাকবে।
বিএনপি’র কয়েকজন নীতিনির্ধারনী নেতা জানান, বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরেই দলের নেতাদের সাথে আলোচনা করে আগামী নির্বাচনের সহায়ক সরকারের রূপরেখা ও প্রয়োজনে আন্দোলনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। তিনি জাতির সামনে সহায়ক সরকারের ফর্মুলা দেয়া ছাড়াও নির্বাচন বিষয়ে অনেক কিছু খোলাসা করবেন। এছাড়া আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্তসহ তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে মাঠে নামার গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনটি, উপদেষ্টা পরিষদের একটি, যুববিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকটি শূন্যপদ পূরণ এবং দল পুনর্গঠন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এছাড়া ছাত্রদল, কৃষকদল, তাতীদল, শ্রমিকদল, মৎসজীবীদলসহ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের কমিটির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আংশিক কমিটি হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির অপেক্ষায় আছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল ও জাসাসের কমিটি। এসব কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে বিএনপির একাধিক সূত্র। পাশাপাশি তৃণমূল বিএনপি চাঙ্গা করতে দ্রæতই বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করবেন দলের প্রধান।
দীর্ঘ তিন মাস লন্ডনে চোখ ও পায়ের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসনের দেশে ফিরে আসার সংবাদ জানার পর থেকেই সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দলের প্রধানের ফিরে আসার জন্য। চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানাতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো কয়েকদফা বৈঠক ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিল্পীরাও। বিমানবন্দর থেকে গুলশান-২ খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত রাস্তার পাশে উপস্থিত থাকবেন বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি চলছে। নেতাকর্মীদের মধ্যেও উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে, অবৈধ সরকারের শাসন চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচনকালীন সরকারসহ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা দিবেন তা বাস্তবায়নে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকবে।
খালেদা জিয়ার অভ্যর্থনা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার তৈরি করছেন বিএনপি ও দলটির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের। জানা গেছে, দেশে ফেরা উপলক্ষে নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ব্যানার, ফেস্টুনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে থাকা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানানো হবে। এ অভ্যর্থনা থেকে খালেদা জিয়াকে ‘গণতন্ত্রের সৈনিক’ উপাধি দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
এছাড়া খালেদা জিয়ার সফর নিয়ে সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অপপ্রচারের চপেটাঘাত হিসেবেও দেখছেন অনেকে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরে আসার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মন্ত্রীদের সমালোচনার জবাব হবে। কারণ তারা মনে করেছিল বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে তাকে দেশের বাইরে রাখা যাবে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা সব সময় বলে এসেছি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন এবং চিকিৎসা শেষে ফিরে আসবেন। তিনি এই দেশ ও দেশের মানুষের নেত্রী। এজন্য তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকবেন না। আর মামলা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা দিয়ে তাকে আটকে রাখা যাবে না। কারণ তিনি আপোষহীন নেত্রী।
এদিকে বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছেন। তারা অপেক্ষা করছেন দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে আসার সংবাদ অন্যদিকে গত রোববার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল নিয়ে প্রশংসা করায় নতুন করে নির্বাচনী আশার সঞ্চার হয়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে। তবে সন্দেহের চোখেও দেখছেন অনেকে। বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেভাবে সত্য কথা বলেছেন এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। একইসাথে শেষ পর্যন্ত তিনি এভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন কিনা তাই দেখার বিষয়। কারণ বিগত দিনেও অনেকে এটা করতে পারেননি।
গত ১৫ জুলাই চোখ ও পায়ের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। পরদিন বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। লন্ডন পৌঁছার পর থেকে বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সেখানে অনেকটা একান্তেই পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন