আমলকী গাছের সম্পূর্ণটাই কাজে লাগে আয়ুবের্দিক ও ইউনানি ওষুধপত্র তৈরি করার জন্য। ফল, বিচি, পাতা, শেকড়, গাছের ছাল ও ফুল সবই ওষুধের কাজে লাগে। বহু শতাব্দী ধরে আয়ুবের্দের চিকিৎসায় এই গাছের সব কিছুই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমলকী ফল নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। আর্থ্রাইটিস, অষ্টিওপোরেনিন, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, বয়স্কদের প্রস্রাবজনিত অসুখে যাতে উপকার পাওয়া যায় সেইরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। তাছাড়া চুল পড়ে যাওয়া বা অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়া এইসব চুল সংক্রান্ত সমস্যায় আমলকীর ব্যবহার খুবই বেশি। আমলকীতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ আছে। এই ফলের গাছ সাধারণত মাঝারি সাইজ ৮ মিটার থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়-ডালপালাগুলো থাকে ছড়ানো। এই গাছের ফুলের রং সবুজাভ-হলুদ। ফলগুলো প্রায় গোল মসৃণ এবং শক্ত। ফলগুলোর ছয়টি দাগ থাকে।
আমলকী স্বাদে টক ও কষায়। প্রথমে খেতে কষাটে লাগলেও পরে পানি খেলে মিষ্টি লাগে। চ্যবনপ্রাশের প্রধান উপকরণ হল আমলকী। যাঁরা সর্দি কাশিতে ভোগেন, যাঁরা শারীরিকভাবে দুর্বল, তাদের নিয়মিত চ্যবনপ্রাশ খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে। এটা একটা আয়ুর্বেদিক টনিক। শিশুদের পক্ষেও ভালো। শীতকালে এর ব্যবহার বেশি।
আমলকী খেলে অনেক রোগের হাত থেকে নি®কৃতি পাওয়া যায়, অনেক রোগ সারে। আয়ুর্বেদ মতেও আমলকী একটি শ্রেষ্ঠ ফল। আমলকী যেভাবেই খাওয়া যাক, পাকা বা কাঁচা শরীরে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ জোগাবে। বলতে গেলে পাঁচ-ছটা কমলালেবুর সমান ভিটামিন ‘সি’ আছে ১টা আমলকীতে। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, কমলালেবুতে যে ভিটামিন পাওয়া যায়, তার চেয়ে কুড়িগুণ বেশি ভিটামিন পাওয়া যায় আমলকীতে।
আমলকীতে পেকটিন ও অ্যাসিডও আছে। টাটকা আমলকীর রস সকালে উঠে খালি পেটে খেলে শরীর পুষ্ট হয় ও মন প্রফুল্ল থাকে। আমলকীর রস ও আখের রস একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে মূত্রকৃতার বা প্রস্রাব কম হওয়ার ক্লেশ দূর হয়। আমলকী ও হলুদ একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে মূত্রমার্গের দাহ শান্ত হয়, প্রস্রাব পরিষ্কার হয়। আমলকীর রস ও পাকা কলা একসঙ্গে চটকে খেলে মেয়েদের বহুমূত্র রোগ নিরাময় হয়। আয়ুর্বেদ মতে আমলকীর গুণাবলি হাজার।
যে কোনও ঋতুতে, যে কোনও দেশে, যে কোনও বয়সের ব্যক্তির পক্ষে আমলকী খাওয়া হিতকর। চ্যবন ঋষি বৃদ্ধ বয়সে আমলকী দিয়ে তৈরি চ্যবনপ্রাশ খেয়ে আবার যুবক হয়ে গিয়েছিলেন। আমলকী বীর্য বৃদ্ধি করে। শুকনো আমলকী কেশ বৃদ্ধি করে। আমলকী টাটকা বা শুকনো খেলে বা প্রলেপ লাগালে ভগ্ন অস্থি তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে-এরকম বলা হয়ে থাকে। শরীরে আমলকী বেটে লাগালে শ্রীবৃদ্ধি হয়। আমলকী ত্রিদোষ কফ, পিত্ত, বাতনাশ করে। সপ্তধাতুর পুষ্টি করে বলে আমলকী উত্তম রসায়ন। রক্তশুদ্ধি করে, মূত্র বৃদ্ধি করে, পিত্তের প্রকোপ কমিয়ে দেয়, মল নিঃসরণ করে এবং রুচিকর। রক্তপিত্ত সারিয়ে দেয়। আমলকী শীতবীর্য অর্থাৎ শরীরে ঠান্ডা প্রভাব বিস্তার করে শরীরের উষ্ণতা কমিয়ে দেয়।
আমলকীর আছে শুদ্ধির গুণ-সেইজন্য রক্তের মধ্যে একত্রিত বিষ, মল প্রভৃতি দূর করে রক্ত পরিষ্কার করে দেয়। রক্তের মতো মাংসেও প্রবেশ করে মাংসের ক্লেদ নষ্ট করে দেয় ও পেশি শুদ্ধ করে। এই রকমই আমলকী অস্থিতেও প্রবেশ করে মজ্জা ও বীর্যাশয় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে শুক্রেরও শুদ্ধি করে। এইভাবে আমলকী রক্ত, মাংস ও অস্থি তিনটির উপরই সুপ্রভাব বিস্তার করে। সাধারণত টকজাতীয় পদার্থ খেলে পিত্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিপাকে (হজমের পর) মধুর হওয়ার জন্য আমলকীর সেই দোষ নেই। আমলকী মধুর ও শীতল বলে এটা খেলে সব রকম দাহের নিবৃত্তি হয়। মেয়েদের ঋতুস্রাব, নাক থেকে রক্ত পড়া, অর্শ থেকে রক্ত পড়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়া, রক্ত আমাশয় প্রভৃতি অসুখে আমলকী খেলে উপকার পাওয়া যায়। সেইজন্য আমলকীকে সমস্ত ফলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়ে থাকে।
আয়ুর্বেদে ভোজনের আরম্ভে, মধ্যভাগে এবং শেষে নিয়মিত আমলকী খেতে বলা হয়েছে। এই ফলের গুণ অমৃত সমান-সেই জন্য একে অমৃতফলও বলা হয়। পরিচর্যায় মায়ের মতো উপকারী বলে একে বলা হয় ধাত্রীফল। আমলকী টক, মধুর রসযুক্ত, কষায়, ক্ষারক (মল নিঃসরণ করে)। চোখের পক্ষে উপকারী, সমস্ত দোষ নষ্ট করে বীর্ষবর্ধক। রক্তপিত্ত ও (স্কার্ভি) ও প্রস্রাবের পীড়া সারিয়ে দেয়। চরকের অভিমতে আমলকী খেলে বয়স বোঝা যায় না-সেই জন্য তিনি আমলকীর নাম রেখেছিলেন বয়ঃস্থাপন। আমলকী যৌবন স্থির রাখে এই অভিমত সমর্থন করতেন বানভট্টও । মধু মিশিয়ে খেলে যোনিপ্রদাহ শান্ত হয়। শুকনো আমলকী চুর্ণ, ঘি ও মধু সমপরিমাণে মিশিয়ে খেলে শিরশূল (মাথাব্যথা) সেরে যায়। আমলকী ও আঙুর রস সমপরিমাণে নিয়ে পিষে ঘি মিশিয়ে মুখে রাখলে জ্বরের জন্য জিভ গলা ও তালু শুকিয়ে যাওয়ার কষ্ট দূর হয়। আমলকী পুড়িয়ে নিয়ে তিন তেলে ফুঁটিয়ে লাগালে চুলকানি সারে। বৈজ্ঞানিক মতে আমলকীতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ আছে।
আমলকী লৌহতত্তে¡ ভরপুর। সেই জন্য শরীরে নতুন রক্ত তৈরি করবার পক্ষে উপযুক্ত। কৃত্রিম ভিটামিন ‘সি’ না খেয়ে টাটকা বা শুকনো আমলকী খেলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। ত্রিফলা আয়ুর্বেদের একটি অতি পরিচিত ওষুধ। এই ওষুধ কফ, পিত্ত, প্রমেহ, কুষ্ঠ সারিয়ে দেয়। পায়খানা পরিষ্কার করায়। চোখের পক্ষে ভালো। খিদে বাড়িয়ে দেয়। রুচি উৎপন্ন করে। ম্যালেরিয়া রোগেও উপকারী। ত্রিফলার মধ্যে হরীতকীর চেয়েও আমলকীর গুণ ও প্রভাব বেশি। আমলকীর রস অবশ্য টক ও কষাটে স্বাদের। অতএব অল্প করে খাওয়ার অভ্যেস করবেন। আমলকীর কষাটে স্বাদের ব্যাপারে পাঞ্জাবি বৃদ্ধদের একটা প্রবাদ বাক্য চালু আছে-আমলকীর স্বাদ খাওয়ার সময় নয়, খাওয়ার পরে বোঝা যায়। যেমন বৃদ্ধদের কথা প্রথমে শুনতে ভালো না লাগলেও এসব কথার ফলাফল পরে পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি আমলকিও স্বাদে কষাটে কিন্তু খাওয়া শেষ করলে মুখে মিষ্টিভাব আসে। আমলকী সারা বছর পাওয়া যায় না। টাটকা আমলকী যখন পাওয়া যাবে তখন এইভাবে জ্যাম তৈরি করে নিন তাহলে আমলকী যখন পাওয়া যাবে না তখনও আমলকী খেতে পারবেন। বিশেষ করে এই জ্যাম আঁচে বসিয়ে রান্না না করে তৈরি করা হয় বলে আমলকীর প্রায় সব পুষ্টিমূল্যই বজায় থাকে।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন