বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

মা ঠে র বা ই রে

প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশ্বমঞ্চে আগমন ‘ফান ক্রিকেট’ হিসেবে। তবে এক দশকের একটু বেশি সময়ের মধ্যেই টি-টোয়েন্টি বেশ ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠেছে। চার-ছক্কার ফুলঝুরি, বলে বলে রোমাঞ্চ, রেকর্ড ভাঙা গড়ার খেলা যেন ছোট্ট এই ফরম্যাটকে বেশ বড়-ই করে তুলেছে দিন দিন। মাঠের খেলায় যেমন, তেমনি মাঠের বাইরের টিভি-সত্ত্ব, দর্শক আগ্রহ আর অর্থের ঝনঝনানিতেও। আর ক্রীড়ামোদীদের সেই আনন্দ অনেকগুণ বেড়ে যায় ক্ষুদ্র এই সংস্করণের বড় মঞ্চটি এলেই। এবারের বিশ্বকাপ আসরটি আরেকটু বেশিই যেন আলো ছড়ানোর পসরা সাজিয়ে বসেছে টি-২০’র ফেরিওয়ালা ভারত। সেই আলোর কিছুটা নয়, অনেকটা এসে পড়েছে বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদের ওপরও। তাদের সেই উত্তেজনাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে মাঠের সাথে সাথে মাঠের বাইরের খবরা-খবরও প্রতিনিয়তই দিয়ে যাচ্ছেন দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা শামীম চৌধুরী। ধর্মশালা, কোলকাতা আর ব্যাঙ্গালুরু ঘুরে গত এক সপ্তাহে তার পাঠানো বিশ্বকাপের ডায়রি থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমাদের আজকের মা-ঠে-র-বা-ই-রে

 

সেই শোয়েব আলী ধর্মশালায়ও
দেশ ও বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা চলাকালে পুরো শরীরে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে রং মেখে গ্যালারি মাতিয়ে রাখেন যে শোয়েব আলী, সেই শোয়েব আলী এখন ধর্মশালায়। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় শুরু হয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলা। আসরের মুল পর্ব শুরু হওয়ার আগে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে বাছাইপর্ব। এই পর্বে বাংলাদেশকেও খেলতে হচ্ছে। আর গতকাল নিজেদের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে ৮ রানে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছে মাশরাফি বাহিনী। ম্যাচে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা যখন মাঠের লড়াইয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনি ধর্মশালা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ‘হলুদ’ সমর্থকদের গর্জনে মুখোরিত হয়ে উঠলো। হলুদ জার্সি পড়া দলটিতে রয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) সদস্যরা। বাংলাদেশের খেলা মানেই তাদের উল্লাস ও উচ্ছাস। সব সময়ই বিরামহীন ভাবে তারা দেশের প্রিয় ক্রিকেটারদের সমর্থন দিয়ে যান। গর্জে উঠেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চিৎকারে। দেশের মাটি ছাড়িয়ে তাদের এই গর্জন কাল শুনা গেছে ধর্মশালা স্টেডিয়ামও।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলা দেখতে এবং টাইগারদের সমর্থন দিতে গত ৫ মার্চ ১৮ সদস্যের বিসিএসএ দল ঢাকা থেকে ধর্মশালার উদ্দেশে যাত্রা করে। এই দলে আছেন স্টেডিয়ামের গ্যালারি মাতিয়ে রাখা ‘টাইগার শোয়েব আলী’। যিনি গতকালও পুরো শরীরে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে রং মেখে ম্যাচ চলাকালে গর্জন করে গ্যালারি মাতিয়ে রাখেন। এছাড়া বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে ধর্মশালা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রায় হাজার খানেক বাংলাদেশী সমর্থক মাশরাফিদের উৎসাহ দিয়েছেন। গ্যালারীতে উড়িয়েছেন লাল-সবুজ পতাকা। তাদের গর্জনে কাল যেন ধর্মশালা স্টেডিয়াম পরিণত হয়েছিলো এক টুকরো বাংলাদেশে।

ধর্মশালায় তিব্বতের স্বাধীনতার ডাক
বিসিসিআই’র সেক্রেটারি বলে ধর্মশালাবাসীদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তানের মতো হাই ভোল্টেজ ম্যাচ আয়োজনে ধর্মশালাকে বেছে নিয়ে আইসিসিকে পর্যন্ত রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু নিরিবিলি শান্ত শহরটিতে তিব্বতের স্বাধীনতাকামী জনতার আবাসস্থল, তিব্বতের স্বাধীনতাকামী জনতার আন্দোলনের নেতা দালাইলামাকে কেন্দ্র করে তাদের সব স্বপ্ন-সেই শহরটি হঠাৎই যেনো হয়ে উঠেছে আন্দোলনের নগরীতে। ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচটি ধর্মশালা থেকে কোলকাতায় স্থানান্তর করেও শান্ত হতে পারছে না শহরটি। গতকাল রাজধানীর কোতোয়ালী বাজারের রাস্তাটি যেনো দখলেই ছিল তিব্বতের স্বাধীনতাকামী জনতার। ম্যাকলিডগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে, পাহাড়ি পথ বেয়ে তিব্বতের স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার মিছিল। মিছিলের ভাষাগুলো ‘থাকতে চাই না চীনের সঙ্গে, চাই স্বাধীনতা, তিব্বতের সুরক্ষা ভারত, দালাইলামা জিন্দাবাদ, রক্ত দিবো তবুও দিবো না মাটি’Ñআরো কত কী? যে পোশাকে দেখা যায় দালাইলামাকে, সেই পোশাকে অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পোশাকেও ছিলো হাজারো জনতা। দ্রোহের স্লোগান হলেও তিব্বতের মানুষদের মিছিল চলাকালীন শৃঙ্খলা, উদ্দীপনা, দেশের প্রতি প্রতিজ্ঞা বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। প্রতিবছরই নাকি ১০ মার্চ এমন কর্মসূচি পালন করে থাকে তিব্বতের স্বাধীনতাকামীরা। ১৯৫৯ সাল থেকে এই দিনকে বেছে নিয়ে সারা বিশ্বে একই দিনে এই কর্মসূচি পালন করে থাকে তিব্বতীয় স্বাধীনতাকামীরা। এ মিছিল হয়। এটা তিব্বতের স্বাধীনতাকামী মানুষ প্রতিবছরই করে। তারিখটা ১০ মার্চ। চীনের বেধে দেওয়া বেস্টনি থেকে বেরিয়ে আসার বার্তাটাই দিয়েছে এই মিছিল। হিন্দি ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া এসব স্বাধীনতাকামী থাকতে চায় নাকি ভারতের সঙ্গে। তিব্বতের জাতীয় বিদ্রোহের দিন ১০ মার্চ। এ দিনেই তিব্বতের রাজধানী লাসায় বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। লাসা এখনো চীনের দখলে। ধর্মশালায় পড়েছে লাসার কিয়দাংশ। ওই দিন তিব্বতীদের ধর্মগুরু দালাইলামাকে কিডন্যাপের হুমকি দিয়েছিল চীন। দালাইলামাকে বাঁচাকে নাকি সেদিন ৩ লাখ তিব্বতীয় জড়ো হয়েছিল। ঘিরে রেখেছিল দালাইলামার বাসা। তখন অনেক সাধারণ তিব্বতি মারা গিয়েছিল চীনের আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে। তারপর থেকেই দিনটাকে নিজেদের বিদ্রোহের, স্বাধীনতার মঞ্চ হিসেবে পালন করে আসছে তিব্বত থেকে অভিভাসী হওয়া জনতা। ম্যাকলিডগঞ্জ থেকে এইসব স্বাধীনতাকামীদের মিছিল শেষ হয়েছে ধর্মশালার ব্যস্ত স্পট সিঙ্গিতে এসে। হিমালয় কন্যা হিমাচলের খুব কাছে তিব্বত, ধর্মশালার সকল স্থাপত্যে তিব্বতীয় তিব্বতীয় ভাব। ধর্মশালা ক্রিকেট স্টেডিয়ামটিও তার ব্যতিক্রম নয়। শান্ত এই শহরই হঠাৎ পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জন্য হয়ে উঠেছে অনিরাপদ, সেখানেই তিব্বতীয় আন্দোলন। হবে না কেন, তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা দালাইলামা বাস্তুচ্যুত হয়ে যে এখন ধর্মশালায় পেয়েছেন ঠিকানা।

দালাইলামার আশ্রয়স্থলে
ধর্মশালার চেয়েও অনেক উঁচুতে ম্যাকলিয়ডগঞ্জের অবস্থান। হিমালয় পর্বতকে খুব কাছ থেকে দেখার, হিমালয়ের উপরের তুষারপাতের দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে নেয়ার এর চেয়ে ভাল সুযোগ তো হতে পারে না কারো। পর্যটকদের কাছে তাই ধর্মশালার গুরুত্বটা বাড়িয়ে দিয়েছে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ। পাহাড়ের গিরিপথ বেয়ে উঠতে হবে ১৭৫০ মিটার উপরে। ছোট্ট এই শহরটিকে ঘিরে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে স্বাধীনতাকামী তিব্বতের ধর্মীয় গুরু দালাইলামা। বাস্তুভিটে হারিয়ে ৫ হাজারের মতো তিব্বতীয় ধর্মশালায় করছে উদ্বাস্তু জীবন যাপন। তার পরও তাদের ধর্মীয় গুরু এবং স্বাধীনতাকামী নেতা দালাইলামার আশ্রয়স্থল ম্যাকলিয়ডগঞ্জ বলেই পর্যটকদের ভীড় সারা বছর লেগেই থাকে এখানে।
চীনের কব্জা থেকে তিব্বতকে স্বাধীন করার ডাকটা দিয়েছেন তিব্বতের এই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সেই ১৯৫৯ সালে। ১৯৪৯ সালে চীনের হাতে তিব্বত চলে যাওয়ার এক দশক পর। দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে দালাইলামার এই আন্দোলনে টলেনি চীন। তবে দালাইলামার আন্দোলনের সূত্রপাত যেখানে, সেই ধর্মশালায়ই এখন স্বাধীনতাকামী তিব্বতীয়দের তীর্থভুমি। তিব্বতের স্বাধীনতার বানী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপনে পেয়ে গেছেন নোবেল পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে নোবেল পুরস্কারের পর পরই দালাইলামার জন্য হিমাচল প্রদেশ সরকার ম্যাকলিয়ডগঞ্জে দিয়েছে এক খ- জমি। যেখানেই গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য একটি বিশাল মন্দির। যে মন্দিরের ভেতরে হয়েছে ঠিকানা দালাইলামার। এই মন্দিরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কমপ্লেক্স। সেখানেই ২০০০ সালে স্থাপিত হয়েছে তিববতীয়দের যাদুঘর। যাদুঘরটা উদ্বোধন করেছেন দালাইলামা নিজেই।
১৯৫০ সালের অক্টোবরে চীনের ৪০ হাজার সৈন্যের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী তিব্বতের ৬ হাজার সৈন্যের প্রানান্ত লড়াই, সেই লড়াইয়ে প্রাণ হারানো তিববতীয় সৈনিকদের স্মৃতি স্তম্ভ উঠেছে গড়ে এখানে। চীনের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ১৯৫১ সালের ২৩ মে তিববতের এক দল প্রতিনিধি বাধ্য হয়ে নিজেদের দেশটিকে চীনের হাতে তুলে দেয়ার কাহিনীটাও জানতে পারবেন এখানে এসে। যাদুঘরটি মূলতঃ নির্মিত হয়েছে তিব্বতের স্বাধীনতাকামী জনতার প্রাপ্য অধিকার, স্বাধীন সার্বভৌম তিব্বত প্রতিষ্ঠায় পর্যটকদের সহানুভুতি পেতে। স্বাধীনতাকামী তিব্বতীয়দের জন্য তহবিল সংগ্রহে এখানে আছে দান বাক্স। এক ফ্রেমে টাইম লাইনÑতিব্বতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবর্তনকেই তুলে ধরেছে।
ধর্মশালার কাছে কৃতজ্ঞ তিব্বতের স্বাধীনতাকামী জনতা। কারণ, তাদের আন্দোলেনে যে ধর্মশালা জুগিয়েছে সাহস, আশ্রয়, বাসস্থান। ভবিষ্যত তিব্বতের খসড়া সংবিধান পর্যন্ত এখানে বসেই রচনা করেছে স্বাধীনতাকামী তিব্বতীয়রা। ১৯৯৫ সালে তিব্বত সুপ্রিম জাস্টিজ কমিশনও এই ধর্মশালা থেকেই হয়েছে পরিচালিত।
১৪তম দালাইলামা এখন তিব্বতের ধর্মীয় গুরু, তার মৃত্যুর পর দায়িত্বটা পাবেন ১৫তম দালাইলামা। তবে তাদের উত্তরসূরী হিসেবে যাকে পাওয়ার কথা, সেই পাঞ্চেনলামা শৈশব থেকেই গৃহবন্দি। ১৯৯৫ সাল থেকে তার কোন হদিস জানা নেই তিব্বতীয়দের। আদৌ পাঞ্চেনলামা বেঁচে আছেন কি না, তা জানা নেই তিব্বতীয়দেরও। পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক কারাবন্দি হিসেবে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম উঠতে পারে তার, অন্ততঃ এই বার্তা দিয়ে তিব্বতীয়দের উপর চীনের বর্বরতার কথা জানিয়ে দিচ্ছে যাদুঘরটি। জানেন, দালাইলামার এই আশ্রয়স্থলের নিরাপত্তাকর্মীরাও বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখেন। একজন তো সাকিব বলতে পাগল। পরিচয়টা বাংলাদেশী সাংবাদিক শুনে বাংলাদেশ দলের শুভকামনাও করেছেন তারা।

ভিউ কার্ডও মানবে হার
বরফে ঢেকে যাওয়া পর্বত, হিমাচল রাজ্যের মানুষের কাছে মোটেও অপরিচিত নয়। হিমালয়ের দেশ বলে হিমাচলকে গণ্য করা হয় বলে হিমবাহ এবং তুষারপাত শীতকালে তাদের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধর্মশালা থেকে প্রায় ১২শ’ ফুট উচুঁতে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ থাকেন যারা, বর্ষা মওশুমেও কাছাকাছি থাকা হিমালয়ের উপরে তুষারপাত, জমাট বরফ আস্তে আন্তে গলে সবুজের সঙ্গে সাদার সমারোহÑ তাদের কাছে এমন দৃশ্য বিস্ময়ের কিছুই নয়। তবে টানা ২ দিন একটানা বর্ষণের মধ্যে, কিংবা ঘন কালো মেঘের মধ্যেও দূর থেকে হিমালয় পর্বতের উপর বরফের আস্তরণ Ñএমন দৃশ্য দেখে যে কোন পর্যটকই পড়বে বিস্ময়ের ঘোরে। গতকাল এমন অকল্পনীয় দৃশ্যই দেখতে হলো ধর্মশালায়। ক্রিকেটের সবচেয়ে সুদৃশ্য ভেন্যুর তালিকায় রাখা হয় কেপটাউনের নিউল্যান্ডসকে, সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউন, নেলসন কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ভিনসেন্ট। পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামে বসে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কিন্তু গ্রীষ্ম আসি আসি করছে যেখানে, সেখানে পর্বতের উপর বরফের সমারোহÑএমন দৃশ্য কোন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বসে দেখার সৌভাগ্যÑকল্পনাকেও মানাবে হার। ধর্মশালায় আঁকা বাঁকা লোকালয়ের মধ্যে এক খ- সমতলভুমিতে গড়ে ওঠা হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের স্টেডিয়ামের সৌন্দর্যের যে তুলনাই হয় না অন্য কারো সঙ্গে। বিপদসংকুল পথ, গিরিপথ বেয়ে, নেমে ধর্মশালা স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য ম্যাড়মেড়ে দিনকেও দিয়েছে আনন্দ। বাংলাদেশ মিডিয়া তো বটেই, অনুশীলন করতে এসে আইরিশ ক্রিকেটাররাও সেলফিতে প্রকৃতির এমন বিচিত্র ছবি করেছে ফ্রেমবন্দি।
এমন স্টেডিয়ামে টি-২০ বিশ্বকাপের খেলা দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ আইসিসি। তবে হিমাচল রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন প্রকৃতির অপরুপ রূপের সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজেরাও প্রকৃতির মতো সহজ সরল চরিত্রের। ধর্মশালায় টি-২০ বিশ্বকাপের ম্যাচ বসেছে বলে আতিথ্য দিতে স্টেডিয়ামে একদল বাবুর্চি নিয়ে এসেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বসেই কাঠের চুলোয় হচ্ছে রান্না, ভাত, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে গরম গরম রুটি, আলু পরাটা, আরো কতো কি? মিডিয়া বুফে টেবিল সাজানো হচ্ছে এই গরম খাবারে। শুধু মিডিয়ার জন্যই নয়, সাধারণ দর্শকের খাবারও রান্না হচ্ছে স্টেডিয়ামেই। জানেন, এখানে মিনারেল ওয়াটার বোতল কেনার প্রয়োজন নেই। সাপ্লাই ওয়াটারই সুপেয় এবং বিশুদ্ধ পানি পানের জন্য স্টেডিয়ামে বেশ ক’টি স্পটও আছে। পাহাড়ের পাদদেশে স্টেডিয়ামটির অবস্থান বলে দ্রুত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে ছিল সংশয়। সে সংশয় উড়িয়ে দিয়েছে হিমাচল রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। টানা ১৬ ঘন্টা বৃষ্টির পরও মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে যেভাবে শুকিয়ে মাঠটি খেলার উপযোগী করা হলো, বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড ম্যাচের ওই ৮ ওভারই ছড়াচ্ছে বিষ্ময়। ধর্মশালা থেকে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ চলে গেলেও হিমাচল রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ভিউ কার্ডের চেয়েও সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে দারুন স্থাপত্য শৈলীর স্টেডিয়াম উপহার দিয়ে পাচ্ছে বাহাবা।

হিমাচলের সৌন্দর্য ভাগসু জলপ্রপাত
ধর্মশালার উত্তরে যতোই যাবেন, ততোই উঠতে হবে উঁচুতে। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকবেন, উপর থেকে দেখবেন হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহর ধর্মশালা। খালি চোখে দূর থেকে ধর্মশালা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গোলাপী রঙের প্যাভিলিয়ন ভবনও দেখতে পাবেন অনায়াসে। চোখের নাগালে চলে আসবে হিমালয়, নীচে সবুজের সমারোহ, উপরে শ্বেত শুভ্র বরফের আস্তরণ। কোথাও বা পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরও দেখতে পাবেন। যতোই উঠবেন উপরে, সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে ততোই। কৃত্রিম জলপ্রপাত ভাগসুর দূরত্ব ধর্মশালা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার। হিমাচল রাজ্যে এই জলপ্রপাতের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে টানবেই। দুর্গম পাহাড়ের আঁকা বাঁকা, বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে ট্যাক্সিতে ৪০ মিনিটের ভ্রমণ শেষে ভাগসুতে এসেই কিন্তু থেমে যাচ্ছে না কেউ। দূর থেকে জলপ্রপাতের দৃশ্য জুড়িয়ে যাবে চোখ। তবে খুব কাছে থেকে কৃত্রিম জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখতে হাঁটতে হবে অন্তত: মিনিট বিশেক সময়। তারপর পেয়ে যাবেন ভাগসু জলপ্রপাত। চীনের প্রাচীরের মতো সিডি বেয়ে প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। ধর্মশালার চেয়ে উঁচুতে ম্যাকলিয়ডগঞ্জ, সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে, আরো উঁচুতে ভাগসু জলপ্রপাতের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৯৬০ ফুট উপরে জলপ্রপাত! ভাবুন তো। অবিরাম হাজার হাজার বছর ধরে এই জলপ্রপাত থেকে পড়ছে তীব্র গতিতে পানির ধারা, আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে সেই পানিই কৃত্রিম জলাধার করছে সৃষ্টি, মিশে গেছে নদীর সাথে। গতকাল ধর্মশালার তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রীতে করেছে ওঠা-নামা। ভাগসু জলপ্রপাতের তাপমাত্রা এর চেয়েও কম। ঠা-া কনকনে বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকাই দায়!
ভাগসু জলপ্রপাত থেকে পানির ঝর্নাধারা তীর্যকভাবে পড়ছে, পাহাড় থেকে ঝরে আসা বড় বড় বরফের উপর শোঁ শোঁ শব্দে পড়ছে পানি। উপর থেকে সেই তীর্যক ভূমির উচ্চতা ৩০ ফুট। ভারতে এর চেয়েও বেশ ক’টি বড় কৃত্রিম জলপ্রপাত আছে। তবে ভাগসুর সৌন্দর্যকে ভারতের শীর্ষ ৪টি জলপ্রপাতের মধ্যে রাখতে হচ্ছে। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী প্রায় ৫ হাজার বছর আগে হিমাচলে ভাগসু নাগ মন্দিরের অস্তি¡ত্ব করা গেছে আবিস্কার। এই মন্দিরের খুব কাছাকাছি জলপ্রপাতের অবস্থানকালের বিবর্তনে জলপ্রপাতের নামকরণ হয়ে গেছে ভাগসু জলপ্রপাত। শীতকালে এই জলপ্রপাতের কাছাকাছি যাওয়াটা দুর্গম হিমালয় বেয়ে ওঠার মতোই। গ্রীষ্ম আসি আসি মৌসুমে তাপমাত্রা যেখানে মাইনাসের কাছাকাছি, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বরফ গলা পানিতে পা রাখলে পুরো শরীরটাই হয়ে যাবে হিম, সেখানে শীতকালে পর্যটকরা এখানে আসবে কিভাবে? অথচ কি জানেন, এই জলপ্রপাতের পাশেই ২টি কফি শপ, খাবার দাবারও আছে পর্যটকদের সুবিধার কথা ভেবে। কোথাও এক ফুট, কোথাও বা বড়জোর ৩ ফুট চওড়া পাথরের রাস্তা, পাহাড় কেটে পাথরের সিঁড়ি। দোকানীদের সব মালামাল পরিবহন করছে গাঁধা। স্থানীয় গৃহিণীদের ছাগল চরানো এখানে নিত্যদিনের কাজ। তাদের কাছে দুর্গম পাহাড় বেয়ে ওঠা যেনো দুধভাত। ভাগসুর সৌন্দর্য দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য আছে জলপ্রপাতের প্রবেশ পথে রকমারি পণ্যের মার্কেট। আছে বেশ ক’টি ধাবা টাইপের রেস্তোরাঁ।
ভাগসু জলপ্রপাতের উচ্চতা এক সময় ছিল আরো বেশি। ৭ হাজার ১১২ ফুট থেকে এখন ৬ হাজার ৯৬০ ফুটে নেমে এসেছে এর উচ্চতা। এর পেছনে কারণটাও আছে। ১৯০৫ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে ভাগসু জলপ্রপাতের উপরের অংশ যায় ধসে। ব্রিটিশ আমলে গুরখা রেজিমেন্টের জন্য স্থাপিত সেনানিবাসটি ভাগসুর খুব কাছেই ছিল। ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের জন্য এই ভাগাসু’র কাছাকাছি পাহাড়ের উপর ছিল অফিসার্স মেস, ভূমিকম্পে ল-ভ- হয় সেটিও। ম্যাকলিয়ডগঞ্জ, ধর্মশালা এমনকি ক্যাংরা শহরেও ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় প্রায় ২০ হাজার। ধর্মশালাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানীতে পরিণত করার যে পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশদের, এক ভূমিকম্পে সেই পরিকল্পনা পাল্টে ফেলে তারা। সামার ক্যাপিটাল হিসেবে পরবর্তীতে বেছে নেয় তারা সিমলাকে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন