শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি, লুটপাট, অস্বচ্ছতা ও খেলাপি ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও অবস্থার পরিবর্তনে কোন ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ সভায় উত্থাপিত ত্রিশটি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুতর সংকটের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক কার্যক্রমে প্রচুর অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ধরা পড়লেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডি,পরিচালক বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থ গ্রহণ করা হয় না। বরাবরের মত কিছু দিক নির্দেশনাসহ ‘কঠোরভাবে’সতর্ক করে দিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর তার দায়িত্ব শেষ করেছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। ব্যাংকিং সেক্টরে স্বচ্ছতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে অতীতেও বহুবার নির্দেশনা জারি করা হলেও নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক-পরিচালকরা কোন উদ্যোগ নেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোন অভিযোগের তদন্ত করে দুর্নীতির দায়ে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নৈতিক দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভাবশালী এমডি-পরিচালকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের ধারনা। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা সবারই জানা। প্রায় সবক’টি সরকারী ব্যাংকই ঋণখেলাপের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। মাত্র দু’দিন আগে এনআরবি কর্মাসিয়াল ব্যাংক ও ফার্মার্স ব্যাংকের ঋণ কারসাজি ও টাকা ভাগাভাগির অবিশ্বাস্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
গত বছর বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাংকিং সেক্টরের লুটপাটের চিত্র দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং লুটপাট বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেছিলন। এরপর চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমান বেড়ে ৭৪ হাজার ১৪ কোটিতে দাড়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই খেলাপি ঋণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ার যে তথ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য এলার্মিং। যেখানে অর্থমন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মত দিচ্ছেন, প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভয় পাচ্ছে সেখানে ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের কঠোর অবস্থান ও নির্দেশনার কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীণ ব্যাংকগুলোর বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারি ও ঋণজালিয়াতির শুরুতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারিতে ধরা পড়ার পরও হাজার হাজার কোটি টাকা বেহাত হওয়া থেকে রক্ষার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়িদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হওয়ায় ফার্মার্স ব্যাংক ও এনআরবিসি ব্যাংকে তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ৭৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ এবং লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আর্থিক গোয়েন্দা শাখা এড়াতে পারেনা।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। রেমিটেন্সের প্রধান উৎস গার্মেন্টস রফতানী এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে যে সর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি দায়ী তা নিরসনে কোন কার্যকর উদ্যোগও দেখা যাচ্ছেনা। আগামী বছর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক সংস্কার ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে যে ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা এখনো দেখা যাচ্ছেনা। একদিকে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে, অন্যদিকে প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের সুযোগ অবারিত রেখে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে নজিরবিহিন ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ছোটবড় সব ধরনের বিনিয়োগ, আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান ও আমদানী-রফতানী বাণিজ্যের উদ্যোক্তাদের সহায়ক সেক্টর হিসেবে পরিগণিত ব্যাংকিং সেক্টরে ধস নামলে তা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সরকারী বেসরকারী প্রায় সব ব্যাংকেই জাল-জালিয়াতি ও ঋণখেলাপের খপ্পরে পড়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রির্জাভ হ্যাকিংয়ের মধ্য দিয়ে একইভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ নিয়েও অস্বচ্ছতা ও ছলচাতুরি দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টর ও আর্থিক খাতের প্রায় প্রতিটি বড় বড় কেলেংকারির সাথেই প্রভাবশালী রাঘব-বোয়ালদের জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ও কু-ঋণ বেড়ে যাওয়ার চিত্র থেকেই বোঝা যায় লুটপাট এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বাগ্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভয় বা দুর্বলতা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এরপর সরকারী-বেসরকারী সব ব্যাংকের আর্থিক কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থমন্ত্রনালয় এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিরপেক্ষ ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপ ও ঋণজালিয়াতির সাথে জড়িত প্রভাবশালীদের সম্পদ জব্দ করাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন