বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলা ফিচার

টেনিসেও কালো থাবাা!

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২০ এএম, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬

বছরের এই সময়টায় টেনিস খেলোয়াড়দের পদচারণে মুখরিত থাকে মেলবোর্ন পার্ক। ইয়ারা নদীর পাড়ে থাকে উৎসবের আমেজ।  তবে একটি খবরে সবকিছু যেন ওলট-পালট।
ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে বিশ্বজোড়া পরিচিত ক্রিকেট। পাতানো খেলার বিষবৃক্ষ শেকড় ছড়িয়েছিল সেকান থেকেই। ক্রীড়াঙ্গণের ভয়াবহ অন্ধকার জগতের খোঁজ মিলেছিল এখান থেকেই। এর পর ওলটপালট হলো ফুটবলেও। যেকোনো খেলার মূল রোমাঞ্চ এখানে, এর ফল কী হবে কেউ জানে না। অথচ আগে থেকেই ঠিক হয়ে রাখা হলো সেই খেলার ফল! এবার জানা গেল, সত্যিকারের ভদ্রলোকের খেলা টেনিসেও আছে ম্যাচ পাতানোর ভয়াবহ, দগদগে এক ক্ষত!
বছরের প্রথম গ্যান্ড স্ল্যাম অস্ট্রেলীয় ওপেন শুরুর লগ্নেই বিবিসি ও বাজফিডে প্রকাশিত এমন এক খবর হইচই ফেলে দিয়েছে টেনিস দুনিয়ায়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সও বলছে, টেনিসের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম ৫০-এর মধ্যে থাকা ১৬ জন টেনিস তারকা পাতানো খেলার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে আছেন টেনিসের শীর্ষ টুর্নামেন্ট গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ীরাও! সবচেয়ে বিস্ফোরক তথ্য হলো, টেনিসের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবের টুর্নামেন্ট উইম্বলডনেও ম্যাচ পাতানো হয়েছে!
সংস্থাগুলোর দাবি, পুরুষ টেনিসের পেশাদার সংগঠন এটিপির একটি তদন্ত প্রতিবেদন তাদের হাতে এসেছে। ২০০৭ সালে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিশ্ব টেনিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ও খেলোয়াড়দের ম্যাচ পাতানোর অনেক তথ্য প্রমাণই আছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে এটিপি গঠিত তদন্ত কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, তাতে রাশিয়া, ইতালি ও সিসিলিতে বেটিং (বাজিকর) সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে সন্দেহ করা হয়েছে, সেই বেটিং সিন্ডিকেট টেনিস খেলাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসায় ফেঁদে বসেছে। বিবিসির সেই খবরে বলা হয়, গত এক দশকে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ৫০ জনের মধ্যে থাকা ১৬ জন খেলোয়াড়ের সন্দেহজনক গতিবিধির ব্যাপারে বেশ কয়েকবারই জানানো হয়েছে টেনিসের দুর্নীতি দমন সংস্থা- টেনিস ইনটিগ্রিটি ইউনিটকে (টিআইইউ)। কিন্তু টিআইইউ হয় এ ব্যাপারে সঠিকভাবে তদন্ত চালাতে ব্যর্থ হয়েছে, অথবা তারা এই ১৬ খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
সন্দেহভাজন এই তারকাদের মধ্যে গ্র্যান্ড স্ল্যাম বিজয়ী তারকাও আছে বলে দাবি করেছে বিবিসি ও বাজফিড। তবে তারা বলেছে, ব্যাংক হিসাব, ফোন ও কম্পিউটার অনুসন্ধান ছাড়া এই ১৬ খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এতে করে এর মধ্যে কেউ নিরপরাধ হলে তিনিও মানুষের সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়ে যাবে।
আগুনে ঘি ঢাললেন বিশ্বের এক নম্বর নোভাক জোকোভিচ। তাকেও ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল বলে জানালেন তিনি। মেলবোর্ন পার্কে প্রথম ম্যাচ জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে ১০ট গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক জোকার বলেন, ‘আমাকে সরারসরি কেউ ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দেয়নি। কিন্তু আমার টিমে যারা কাজ করে তাদের মারফত আমার কানে আসে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য প্রায় এক লাখ পাউন্ডের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি শুনেই চমকে গিয়েছিলাম। আমার কাছে এটা জঘন্ন অপরাধ। আমার কাছে স্পোর্টসে এর কোনও স্থান নেই।’ এ ব্যপারে ২১টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী সেরেনা উইলিয়ামসের দাবি, ‘আমি এ ব্যপারে কখনও কিছু শুনিনি।’
গত বছর অন্যান্য খেলার চেয়ে তিনগুণ বেশি ফিক্সিং হয়েছে টেনিসে! ইউরোপিয়ান স্পোর্টস সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসএসএ) এমন তথ্য সরবরাহ করেছে। এই তো কয়েকদিন আগেও সবাই জানতেন, এখন পর্যন্ত জগতের সবচেয়ে নিষ্কলুষ খেলা টেনিস, সেখানেও এমন হাল! এমনকি সেই ফিক্সিং থেকে বাদ যায়নি টেনিসের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী গ্র্যান্ডস্লাম উইম্বলডনও। তিন দিন আগে বিবিসি ও বাজফিড তাদের সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ করে যে, গত এক দশকে টেনিসের সেরা ৫০ র‌্যাংকিংয়ে থাকা ১৬ জন খেলোয়াড়, যাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্র্যান্ডস্লাম বিজয়ী তারকাও আছেন, তারা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এবার জানা গেল, ফিক্সিংয়ের হার ২০১৫ সালেই অন্যান্য খেলার চেয়ে সবচেয়ে বেশি ছিল টেনিসে!  
ইউএসএসএর তিনটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের প্রথম নয় মাসে ৪৯টি সন্দেহভাজন কর্মকা- লক্ষ্য করা গেছে, যেগুলোর সঙ্গে সরাসরি টেনিস কর্মকর্তারা জড়িত! অপরপক্ষে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট ওই তদন্ত কমিটি বলছে, অন্য খেলাগুলোর মোট যোগফল করলে এমন সন্দেহভাজন নড়াচড়া পাওয়া যাচ্ছে মোট ১৬ বার। অবশ্য, এখন পর্যন্ত আগামী বছরের শেষ তিন মাসের প্রতিবেদন ইউএসএস প্রকাশ করেনি। তবে, সংখ্যাটা খুব আলাদা হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, ২০১০ সালেও সন্দেহভাজন সংকেত ছিল চারটি, অথচ এক টেনিসের কারণেই গত বছর সেটা নব্বইয়ের ঘরে চলে গেছে!
এদিকে উইম্বলডনের ব্যবস্থাপনা সংস্থা অল ইংল্যান্ড ক্লাব টেনিস নিয়ে এমন ঝড়ো খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ নড়েচড়ে বসেছে। আন্তর্জাতিক টেনিসের কর্মকর্তারা ফিক্সিংয়ের অভিযোগ নাকচ করে দিলেও ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিচ্ছে না অল ইংল্যান্ড ক্লাব।
অন্যদিকে, টেনিস নিয়ে ক্ষুব্ধ কি-না বোঝা না গেলেও কিংবদন্তি রজার ফেদেরার তার সন্তানদের টেনিস খেলোয়াড় বানাতে চান না বলেই ঘোষণা দিয়েছেন। ফেদেরার হাসতে হাসতে বলেছেন, 'আমি হয়তো তাদের অন্য খেলার ক্ষেত্রে সমর্থন করব। সুপার স্কাইয়ার হোক, খুব ভালো লাগবে। টেনিস খেলা দেখতে যাবে কি-না আমি জানি না।'
ফিক্সিংয়ের ঘটনাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ই বলে দিলেন এক টেনিস খেলোয়াড়। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিক্সিং নিয়ে নিজের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন দক্ষিণ আমেরিকান। নাম প্রকাশে অনিসচ্ছুক এই টেনিসার বলেন, ‘ট্যুরগুলোতে এসব ঘটনা এখন আর গোপন নয়, সবারই তা জানা। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে কথা বলি না।’ সেই খেলোয়াড় এটাও স্বীকার করেন যে শুধু র‌্যাঙ্কিংয়ে নিচের দিকে থাকা প্রতিযোগীরাই এর সঙ্গে জড়িত নয়। এমন কি টেনিস কর্তৃপক্ষ এসব জানেন বলেও অভিযোগ তার। যদিও টেনিস ইনটেগ্রিটি ইউনিট (টিআইইউ) এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সাক্ষাৎকারে ওই খেলোয়াড় উল্লেখ করেন তিনটি বড় গ্রুপ এসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। একেক গ্রুপে খেলোয়াড়দের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অনেক লোক আছে। তারা অন্তত: ৫০ থেকে ৬০টি একাউন্টের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত খেলার আগেই ফল সম্পর্কে খেলোয়াড়দের ভবিষ্যদ্বাণীই তার সন্দেহকে ঘনীভূত করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যখন একজন আমাকে আগামী দুটি টুর্নামেন্টের কারা জিতবে সেই ফল বলে দিয়েছিল। আর খেলায়ও সেই একই ফল হয়েছিল। তখন থেকেই আমি বিষয়টি বিশ্বাস করতে শুরু করি। প্রথম আমি ভাবলাম হয়তো কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে বিষয়টি। পরে যখন দেখলাম প্রত্যেক ম্যাচের ফলই তার কথা অনুযায়ী মিলে যাচ্ছে। এসব ঘটনা মাস্টার্স সিরিজের। যেখানে বড় তারকাগণ এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
টিআইইউ ও এটিপি অবশ্য টেনিসের দুর্নীতির তদন্তে নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। এটিপি প্রধান ক্রিস কারমোড বলেছেন, ‘আমরা কোনোভাবেই দুর্নীতিকে হালকাভাবে নিই না। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রমাণ চেপে যাওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ সত্যি নয়।’ ২০০৯ সালে এটিপি টেনিসে একটি নতুন দুর্নীতি-বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে পুরোনো অভিযোগগুলোর বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করার ব্যাপারে নীতিগত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। কিন্তু এত আগে তদন্ত করা হলেও এ ব্যাপারটি না জানিয়ে কেন উল্টো চেপে যাওয়া হলো, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
এমনটা বলে নিশ্চিন্তে বসে থাকছেন না টিআইইউ ও এটপি প্রধান। বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যামের প্রত্যেকটি ম্যাচের দিকেই এবার কড়া নজর রাখতে চলেছে সংস্থাটি। অস্ট্রেলিয়ার থানাসি কোক্কিনাকিস জানিয়েছেন যে তার সঙ্গেও ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধম্যে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অন্যদিকে, প্রাক্তন ব্রিটিশ ডেভিসকাপার জানান যে একবার তাকেও ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার জন্য খামভর্তি টাকা দেওয়া হয়েছিল। অজি মিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেলবোর্নে চলা অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের প্রথম রাউন্ডের প্রতি পুলিশও কড়া নজর রাখছে।
তাই যদি হয়, নিশ্চিন্ত কী হয়ে র‌্যাকেট চালাতে কি পারছে খেলোয়াড়রা?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন