স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকটে গ্রাম পর্যায়ে ৮০ ভাগ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। থানা বা উপজেলা পর্যায়ে বদলি হয়েও দলীয় প্রভাবে প্রেষণে, ডেপুটেশনের অজুহাত রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে কাজ করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বড় বড় বেসরকারী হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখছেন। এতে করে প্রায় ১২ হাজার চিকিৎসক জেলা, উপজেলা ও গ্রামে থাকছেন না যার কারণে তৃণমূলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের উদ্যেগ। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন সরকারি চাকরি করতে হলে উপজেলা পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ৩ বছর কাজ করতে হবে। কিন্তু তার এই ঘোষণা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না।
সিলেট জেলার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২৫৫টি। কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে ১৫৪টি পদ। সেখানে শূন্য পদ ১০১ জন চিকিৎসকের। খোঁজ নিয়ে জানা যায় চিকিৎসকের শূন্য পদ রয়েছে ১১৪ জন। এর মধ্যে ১৩ জন চিকিৎসক দীর্ঘদিন থেকে অনুমোদিত ছুটিতে রয়েছেন। প্রেষণে রয়েছেন ১৬ জন, এছাড়া ৭১ জন সেবিকার পদ, ৫২টি কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা, ৩৮ জন ফার্মাসিস্টের পদ, ২২টি ল্যাব টেকনিশিয়ান পদ শূন্য রয়েছে। সিভিল সার্জন ইনকিলাব বলেন, এব্যাপারে লেখালেখি করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানা যায়, এ জেলায় ২৪৭টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৮৫ জন। বাকী ১৬২ জন চিকিৎসকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। নার্সিং পদে শূন্য রয়েছে ১৫৮টি। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ ইনকিলাবকে বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবার বিঘœ ঘটছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
মৌলভিবাজার সিভিল সার্জন অফিস জানায়, এ জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৮৫টি। সেখানে কর্মরত আছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে অনুমোদিতভাবে ছুটিতে রয়েছেন ৩ জন। প্রেষণে অন্যত্র কর্মরত আছেন ৪ জন। সিভিল সার্জন ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
ল²ীপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১২৩ জন। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৫৯ জন। ৬৪ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এ জেলায় প্রেষণে রয়েছেন ৭ জন।
যশোর জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে এ জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে ১০৬ জন। কর্মরত আছেন ১০৩ জন।
ময়মনসিংহ বিভাগের অধীন চার জেলায় ৩৬১ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে ১৫৭৫টি। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৯৪ জন, নেত্রকোনায় ১০৬ জন, জামালপুরে ৮১ জন শেরপুরে ৬০ জন, এছাড়া জামালপুর জেলা সদর হাসপাতালে ২০টি চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। ময়মনসিংহের স্বাস্থ্য পরিচালক মো: নুর মোহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি এ সমস্যার দ্রæতই সমাধান হবে।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের নিজ জেলা নিলফামারী। এ জেলার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এখানে মোট চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৮২টি। কিন্তু কর্মরত আছেন মাত্র ৬৮ জন। সেখানে শূন্য রয়েছে ১১৪ জন। অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ। সেখানকার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২০২ জন। কর্মরত আছেন ১৩৬ জন। এখনো শূন্য রয়েছে ৬৬টি পদ।
বরিশাল সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৫৮১ জন, কর্মরত আছেন ৪৮৪ জন, শূন্যপদে রয়েছে ৯৭ জন।
কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩৪২ জন, কর্মরত আছেন ১৯১ জন, শূন্যপদ রয়েছে ১৫১টি।
চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। নার্স, আয়া আর ভাড়াটে চিকিৎসক দিয়েই চলছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলা চরাঞ্চল অধ্যুষিত একটি উপজেলা। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল। এখানে ২১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ৩ জন। সম্প্রতি আর এম ও ডা: মোস্তারী বেগম প্রশিক্ষণে গিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়েছেন ডা: আব্দুস সালাম, তিনি নিয়মিত আসছেন না। থাকেন পার্শ্ববর্তী উপজেলার বাজারহাটের নিজ বাড়ীতে। ২/১ জন স্বাস্থ্য সহকারী থাকলেও তারা নিয়মিত আসেন না। এ হাসপাতালে প্রতিদিন দেড় থেকে ২শ’ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। নার্স আর আয়া-ই তাদের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা। মাঝে মধ্যে, জরুরী প্রয়োজনে ভাড়া করে ডাক্তার আনা হয় এখানে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ইসমত আরা নামে একজন রোগী জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসলে মোস্তাইন বিল্লা নামে একব্যক্তি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ঐ মহিলাকে চিকিৎসা করছেন। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের সেবা ক্লিনিকে কাজ করছেন। ডা: আব্দুস সালাম তাকে পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে ডা: সালাম টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, ডাক্তার না থাকায় আমার নিজ খরচে মোস্তাইনকে দায়িত্ব দিয়েছি। ঐ সময় আমার ডিউটি ছিল না, এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জনের সাথে টেলিফোন আলাপকালে তিনি জানান, এটা সরকারি বিধানে নেই। বিষয়টি আমি দেখছি। সাতকিনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারসহ ৩১টি পদ শূন্য রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
নাগশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দেড়যুগ থেকে কোন ডাক্তার নেই, আন্তঃবিভাগ বন্ধ রয়েছে। বহির্বিভাগে কাজ করে ২ জন স্বাস্থ্য সহকারী। ১০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বলে জানান স্থানীয় ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপস্বাস্থ্যটি নিজেই রোগী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি দুগন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর জরাজীর্ণ টিনসেড ভবনে চিকিৎসা চলছে। এখানে চিকিৎসা নিতে-দিতে কেউ আসেন না।
সিঙ্গাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন ডাক্তার আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা জানেন না। ২/১ জন ডাক্তার থাকলেও তারা কখন আসেন কখন যায় কেউ বলতে পারেননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে ৫০ বেড হাসপাতালে ২১ জন এবং ৩১ বেড হাসপাতালে ৯ জন চিকিৎসক পদ রয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১ জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে। জেলা পর্যায়ে জেনারেল হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালের চিকিৎসকের পদ ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও বর্তমানে সব জেলা উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে কোথাও প্রেষণে ও কোথাও ডিপুটেশন, প্রশিক্ষণে রয়েছেন অনেক চিকিৎসক। অনেকে সপ্তাহে ২ দিন অনেকে মাসে ৪ দিন হাজিরা দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর বেসরকারি হাসপাতাল এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বেশিরভাগ চিকিৎসক শহরে থাকতে চায়। উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি চিকিৎসাসেবা নেই বললেই চলে। দেশের বেশিরভাগ উপজেলা একই চিত্র পাওয়া যাবে, তিনি বলেন, দলীয় পরিচয়ে এসব চিকিৎসকরা বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রি নেয়ার জন্য উপজেলা হাসপাতালে থাকছেন না। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে প্রশিক্ষণের জন্য ১ বছর কাউন্ট করা হয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ৩ বছর কাউন্ট করা হয়। এজন্য চিকিৎসকরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন সাব সেন্টারে থাকতে আগ্রহী না। প্রশিক্ষণ শেষে উপজেলা পর্যায়ে এসব চিকিৎসকের পদ থাকছে না বিধায় তারা বড় হাসপাতালে থেকে যায়। এভাবে প্রশিক্ষণ, ডেপুটেশন এবং প্রেষণের নামে প্রায় ৬/৭ হাজার চিকিৎসক রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। এসব চিকিৎসক ঐসব জেলা-উপজেলা থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। কাগজ-কলমে জেলা-উপজেলায় রয়েছেন, বাস্তবে নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঢাকায় বিভিন্ন সভা সেমিনারে চিকিৎসকদের নানাভাবে সতর্ক হুঁশিয়ার করছেন কর্মস্থলে না থাকলে শাস্তি হবে, চাকরিচ্যুত করা হবে। এসব কিছুতেই ভয় পান না চিকিৎসকরা। তাদের চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ও বিএমএ নেতৃত্বে নিজেদের মত করে চলছেন, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা: সমীর কান্তি সরকার ইনকিলাবকে জানান, সারাদেশে চিকিৎসকের পদ রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার। শূন্যপদে রয়েছে প্রায় ২ হাজার। নতুন নতুন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলেও অধ্যাবদি নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি। প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার চিকিৎসক অবসরে যান। ২০১৪ সালে ৬ হাজার ৩শ’ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শূন্যপদ পূরণে ৫ হাজার নতুন চিকিৎসক নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জরুরীভাবে তাগিদ ও দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের শূন্যপদ পূরণে বিসিএস এর মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ হচ্ছে। ৩৭তম বিসিএস থেকে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসক নেয়ার জন্য আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। প্রেষণ ও ডেপুটেশন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের গুরুত্ব দেখেই অনেক ক্ষেত্রে বাইরের বদলীকৃত চিকিৎসককে ঢাকায় রাখা হয়। নিয়মিত পদ অথবা জনবল পূরণ হলে তারা তাদের বদলীকৃত কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। তিনি আরও নতুনভাবে ৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করা হলে তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে।
সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সূত্রমতে সারাদেশে ২ হাজার চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশী। জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্য-বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অননুমোদিত চিকিৎসক প্রেষণ ডেপুটেশন, কাগজে-কলমে উপস্থিতি এবং বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের অজুহাতে প্রায় ১২ হাজার চিকিৎসক অনুপস্থিতি রয়েছেন। যে কারণে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মফস্বলের চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন