শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

হিন্দু পরিবারের আতঙ্ক কেটে গেলেও কাটেনি মুসলিম পরিবারগুলোর

রংপুরে সংঘর্ষ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে : | প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টিটুকে গ্রেফতারে ক্লোজডোর অপারেশন চলছে
হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কটূক্তি এবং পবিত্র কাবা ঘরকে অবমাননা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনার ৩ দিন পরও আতঙ্ক কাটেনি পার্শ্ববর্তী ৪/৫ গ্রামের মুসলিম পরিবারগুলোর। ঘটনাস্থল ঠাকুরবাড়ির পার্শ্ববর্তী ৪/৫টি গ্রাম এখনও পুরুষশূন্য রয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকার পুরুষ লোক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি গ্রেফতারের ভয়ে নির্দোষ ব্যক্তিরাও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। অগ্নিকান্ড ও ভাঙচুর হওয়া সকল বাড়িঘর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদর ইউএনও’র তত্বাবধায়নে পুনর্নির্মাণসহ ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের কাজ বেশ জোরেশোরেই চলছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলো বেশ খুশি এবং তাদের মাঝে আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু ঘটনার নায়ক আলোচিত সেই টিটুকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ জানিয়েছেন, টিটুকে গ্রেফতারের জন্য ক্লোজডোর অপারেশন চলছে। যে কোন মুহূর্তে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে শুক্রবারের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া হাবিবুব রহমানের লাশ গত শনিবার রাত ১০টায় পুলিশী পাহারায় দাফন করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করায় বেশ খুশি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু রাফা মোহাম্মদ আরিফ সাংবাদিকদের জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলেছি। দুর্বৃত্তদের সনাক্ত করতে পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা কাজ করছে। এরমধ্যে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা প্রকৃত সত্যটা বের করে আনতে চাই। সেজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ইনশা আল্লাহ সময়মতো কাজ এগিয়ে নিতো পারবো। বিভিন্ন ধরনের কথা আসছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তা আমরা প্রকাশ করতে পারছি না। তবে প্রকৃত ঘটনাকে বের করতে অনেক সময় লাগবে।
রংপুর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, অভিযুক্ত টিটুকে গ্রেফতারের জন্য ক্লোজডোর অপারেশন চলছে। যে কোন মুহূর্তে তাকে গ্রেফতার করা হবে। ফেসবুক আইডিটি টিটুর নয় মর্মে তার পরিবারের দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই ফেসবুক আইডিটি যে টিটোর নয়, সে কথাতো কোথাও বলা নেই। এরপরেও আমরা আইডিটি সঠিকভাবে সনাক্ত করার জন্য সিঙ্গাপুরে এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়েছি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান সাইফ জানান, আইডি সম্পর্কে আমরা খোঁজ খবর করছি। প্রাথমিকভাবে আইডিটা যে টিটুর তা জানা গেছে। তবুও আমরা এক্সপার্ট ওপেনিয়নের মাধ্যমেই বিষয়টি পরিষ্কার করবো। গঙ্গাচড়া থানার ওসি তদন্ত নজরুল ইসলাম জানান, রাজু আহম্মেদ অভিযুক্ত টিটুর বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেছে। ফেসবুক আইডিটি যে টিটোর সেটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে সব কিছুই খোলাসা করা হবে এক্সপার্ট ওপেনিয়নের পর। মামলার সময় সেখানে যারা যারা এসেছিলেন তাদেরকে আমরা স্বাক্ষী হিসেবে মামলায় দিয়েছি।
রংপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও রংপুর জেলা যুব মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছিমা জামান ববি বলেছেন, ঘটনাস্থল ঠাকুরবাড়ির পরিস্থিতি একেবারেই শান্ত। তাদের ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। কিন্তু একটি উগ্রবাদী চক্র হিন্দুদের ইমোশনের জায়গাকে তাক করে তাদের উস্কানী দেয়ার চেষ্টা করছে। তিনি গতকাল দুপুরে ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন কার্যক্রম তত্বাবধায়ন করতে এসে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি শান্ত। আইনশৃংখলাবাহিনী তাদের নিরাপত্তায় রাতদিন পরিশ্রম করছে। কিন্তু একটি চক্র বিভিন্নভাবে হিন্দুদের উসকানোর চেষ্টা করছে। তারা নানা নামে মানববন্ধন করছে। এটা ঠিক নয়। ববি বলেন, আমরা যাদের একটি ঘর পুড়ে গেছে তাদের ৫০ হাজার, যাদের ২টি ঘর পুড়ে গেছে তাদের ১ লাখ, যাদের ৩টি পুড়ে গেছে তাদের দেড় লাখ এবং যাদের চারটি ঘর পুড়ে গেছে তাদের ২ লাখ এবং যাদের ক্ষতি হয়েছে তাদের ৩০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছি। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসন কার্যক্রমে খুশি। তাদের মধ্যে কোন আতঙ্ক নেই।
প্রসঙ্গতঃ গত ৪ অক্টোবর মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও পবিত্র মক্কা শরীফকে অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি আপলোড ও স্ট্যাটস দেয়ার অভিযোগে রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরবাড়ি গ্রামের খগেন্দ্র নাথের পুত্র এমডি টিটোর বিরুদ্ধে গঙ্গাচড়া থানায় আইসিটি আইনে এজহার দায়ের করেন শলেয়াশাহ লালচাঁদপুর এলাকার আব্দুস ছাত্তারের পুত্র পোল্টিফার্ম ব্যবসায়ী রাজু আহম্মেদ। তিনি টিটুর বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনেন। পুলিশ মামলাটি গ্রহণের ব্যাপারে সদর দপ্তরে অনুমতির জন্য ফ্যাক্স পাঠায়। সেখান থেকে মামলাটি গ্রহণের ব্যপারে অনুমতি দেয়ায় ৬ নভেম্বর থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামেন পুলিশ প্রশাসন। যেকোন ধরনের অপ্রতিকর পরিস্থিতি এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় পাগলাপীর, ঠাকুরবাড়ি ও শলেয়াশাহ এলাকায়। পরের দিন স্থানীয় লোকজন টিটোর গ্রেফতার দাবিতে পাগলাপীরে বিক্ষোভ করে। একই দিনে তাকে গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া এলাকাবাসী। কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার না হওয়ায় আবারও টিটুকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধনের ডাক দেয় এলাকাবাসী। তারা এ নিয়ে মাইকিং ও প্রচারণা চালায়। এরপর সেখানে আরও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। জুমআর নামাজের পর শলেয়াশাহ বাজারে কয়েক হাজার মুসল্লী মানববন্ধন করতে থাকে। এতে বাধা দেয় পুলিশ। খবর পেয়ে আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মুসল্লী শলেয়াশাহ বাজারে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে মানববন্ধন বিক্ষোভে রূপ নিলে পুলিশ ব্যারিকেড দেয় যাতে তারা ঠাকুরবাড়ি গ্রামের দিকে না আসতে পারে। এনিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মুসল্লীরা। একসময় হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ ঠাকুরবাড়ি গ্রাম পর্যন্ত চলে আসে। এসময় কিছু দুর্বৃত্ত হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলি ছোঁড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান লালচাদপুর গ্রামের রিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র হাবিবুর রহমান। এসময় ৬ জন গুলিবিদ্ধও হন। এরমধ্যে মাহবুবুর রহমান নামের এক গুলিবিদ্ধ মুসল্লী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছে। এ ঘটনার পর পুলিশ বাদি হয়ে ২ হাজারেরও অধিক ব্যক্তিকে আসামী করে সদর ও কোতয়ালী থানায় দুটি মামলা করে। শুক্রবার ঘটনার সময় থেকে শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত ৫৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে হিন্দু পল্লীতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুরু হয় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম। গতকাল রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে দেখা গেছে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সদর ইউএনওর তত্ত¡াবধানে পুনর্বাসনের কাজ অত্যন্ত দ্রæত গতিতে চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলোর মাঝে আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গেছে। পুনর্বাসনের কাজে তারা বেশ খুশি।
টিটুকে গ্রেফতার করতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জে গেছে : ডিআইজি রংপুর
রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম, পিপিএম বলেছেন, দুর্বৃত্তরা যে দলেরই হোক না কেন তাদের দলীয় পরিচয় নয়, একজন আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। গতকাল দুপুরে রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরবাড়ি গ্রামে হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে কমিউনিটি পুলিশিং রংপুর জেলা সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান কালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরবাড়ি এলাকায় হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গত দুদিনে রংপুর কোতোয়ালি থানা ও গঙ্গাচড়া থানা এলাকা থেকে ১শ’ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা এই মামলাকে সবোর্চ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি এবং মামলার প্রধান আসামি টিটু রায়কে গ্রেফতার করার জন্য রংপুর জেলা পুলিশের কয়েকটি দল নারায়ণগঞ্জে গেছে। টিটু রায়কে গ্রেফতার করা হলেই ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার প্রকৃত বিষয়টি উম্মোচিত হবে। পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে হিন্দু স¤প্রদায়ের জানমাল ও বাড়ি-ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশ বদ্ধপরিকর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সা¤প্রদায়িক বিশৃঙ্খলাকারীদের স্থান নেই। যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা হবে। ক্ষতিগ্রস্থ ১০টি পরিবারকে বাড়ি-ঘর নির্মাণে ৫ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এসময় রংপুর জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ফজলে এলাহী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এবিএম জাকির হোসেন, কোতোয়ালি থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ বাবুল মিয়া, গঙ্গাচড়া থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ জিন্নাত আলী, কমিউনিটি পুলিশিং কমিউনিটি পুলিশিং রংপুর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব সুশান্ত ভৌমিক উপস্থিত ছিলেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সৌরভ ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৩:২২ এএম says : 0
দেশের মুসলমানরাও কী রোহিঙ্গা হয়ে যাচ্ছে ?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন