জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতার প্রস্তাব করেছিল চীন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে এই প্রস্তাব দিয়েছে। জাতিসংঘ থার্ড কমিটির প্রস্তাবে রাখাইনে সামরিক অভিযানের ইতি টানতে এবং রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারসহ নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই এ যাবৎ জাতিসংঘের উদ্যোগগুলোর বিরোধিতা করেছে চীন। সর্বশেষ থার্ড কমিটির প্রস্তাব পাস হওয়ার পরও চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান জাতিসংঘ দিতে পারবেনা। এদিকে মিয়ানমারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এশিয়া-ইউরোপের(আসেম) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ১৩শ বৈঠকে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল বন্ধ করে দ্রুত তাদের দেশে ফেরত নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আসেম সম্মেলনে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশসমুহ বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেয়া হয়। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা থেকে নেইপিদোতে গিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাত শেষে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাদের ৩ দফা প্রস্তাব পেশ করেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়ন করা, বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌছতে চীনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব এবং রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সেখানকার দারিদ্রবিমোচনে মনোযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে চীনা বিনিয়োগের পাশাপাশি আন্তজার্তিক বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমরা জানি মিয়ানমারে ও রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সাথে রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন,মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশকে নিয়ে যে অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে রোহিঙ্গা সংকট সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেও প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করছে চীন। তিন দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করতে গিয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে চীনের নিকটতম বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন। যদিও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন বরাবরই মিয়ানমারের অমানবিক অবস্থানের প্রতিই অনেকটা প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে আসছে। তবে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থন ও অব্যাহত চাপ চীনের মত এশীয় পরাশক্তির পক্ষে উপেক্ষা করা কঠিন। আমরাও বিশ্বাস করি বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগি ও অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে চীন বাংলাদেশের ন্যায্য অবস্থানের পাশেই থাকবে। দীর্ঘদিনের নিরবতা ভেঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ঘোষিত অবস্থান ও ৩ দফা প্রস্তাব এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়েই রোহিঙ্গা সংকট একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে যেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। তবে শুধু প্রস্তাব দিলেই হবেনা প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাংলাদেশ চীনের প্রভাব ও সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখতে চায়।
রোহিঙ্গা সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক সমস্যা হলেও মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যনীতিই এর জন্য দায়ী। আন্তর্জার্তিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা সংকটকে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে এ সমস্যা সরাসরি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করায়ং এটি এখন আর মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। রাখাইনে গত আগস্ট মাসে শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পর থেকে ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে গত চার দশকে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার বাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে আরো অন্তত ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব যখন চীনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তখন রোহিঙ্গা সংকটের সামাজিক-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হাত দিতে হবে। রাখাইনের ভূমিপুত্র ও হাজার বছরের ইতিহাসে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থান বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে বাংলাদেশকে কার্যকর ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। আঞ্চলিক বাস্তবতায় চীন এবং ভারতের প্রভাব কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথ এগিয়ে নেয়া বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত: পশ্চিমাবিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন, চীনের প্রস্তাব ও প্রভাব এবং মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার মেলবন্ধন বা সমন্বয় অনেক দূরূহ ও জটিল বিষয়। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রাথমিক উদ্যোগ ইতিমধ্যেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। চীনা প্রস্তাবের দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌছার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সামগ্রিকভাবে সেটিই সবচে জটিল ও অনিশ্চিত ধাপ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। চীনের প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে কাজে লাগিয়ে এ ধাপ অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা ও উদ্যোগ আরো জোরালো করতে হবে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটের মত বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বার্থে দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন