শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর এলেম বা জ্ঞান ও মনীষা

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এলেম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জানা। কিন্তু প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত জানা বা বুঝার শ্রেণীভেদ এবং মনীষার প্রকারভেদ পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। আর আম্বিয়ায়ে কেরামের সহযোগে যখন এর ব্যবহার হয়, তখন প্রকৃতই আল্লাহর তৌহিদ, জাত ও সিফাত, দ্বীন ও শরীয়তের আহকাম এবং চারিত্রিক শিক্ষাকে বুঝানো হয়। হযরত ইবরাহীম (আ:) তৌহিদের উপর প্রমাণ উপস্থাপন করে স্বীয় পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! আমার কাছে এলেমের ঐ অংশ এসেছে, যা আপনার কাছে নেই। (সূরা মরিয়াম : রুকু-৩) হযরত খিজির (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, আমি নিজের নিকট হতে তাকে শিক্ষা দিয়েছি। (সূরা কাহাফ : রুকু-৯)
আল্লাহ পাকের নিকট হতেই সবকিছু নির্বাহ হয়। তাহলে নিজের নিকট হতে শিক্ষা দেয়ার অর্থ কি? প্রতিটি বস্তুু যা মানুষের স্বকীয় পরিশ্রম, চেষ্টা গবেষণা ইত্যাদি মামুলী উপকরণাদি ছাড়া অর্জিত হয়, সেগুলোকে আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত বলা হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর নিকট হতে এলেম দান করার অর্থ হচ্ছে, সে জাতীয় জ্ঞানলাভ করা যা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানোপকরণ, প্রমাণ উপস্থাপন এবং চিন্তা ও পরিশ্রম ছাড়া অর্জিত হয় এবং তাই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান। আর একারণেই সুফিয়ায়ে কেরামের পরিভাষায় একে এলমে লাদুন্নী বলা হয়। আর হযরত দাউদ (আ:) ও সুলাইমান (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এবং আমি দাউদ ও সুলাইমান (আ:)-কে জ্ঞানদান করেছি।” (সূরা নমল : রুকু-২) আর হযরত ইউসুফ (আ:)-এর নবুওতের শুভলগ্নে ইরশাদ হয়েছে, “এবং এভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে মর্যাদাশীল করবেন, এবং তোমাকে স্বপ্ন-রহস্য সংক্রান্ত বাক্যাবলী শিক্ষা দিবেন এবং তোমার উপর স্বীয় পুরস্কার পরিপূর্ণ করবেন।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-১০) তবে এই আয়াতে এই এলেমের কথা উল্লেখ নেই যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে সময় নির্ধারিত অহী। কেননা এখানে কালামের পূর্বানুসৃতির দ্বারা একবারেই এলেম দান করার কথা ব্যক্ত হয়েছে যা সব সময় নির্ধারিত অহীর শান হতে পারে না। বিশেষ করে আয়াতের শেষাংশে বাক্যাবলীর বিশ্লেষণসূচক জ্ঞান একবারে দেয়ার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এ জন্য হযরত ইউসুফ (আ:) একটি স্বপ্নের তাবীর বয়ান করে অপর একস্থানে বলেছেন, এটা ঐ জ্ঞান, যা আমার প্রতিপালক আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা ইউসুফ : রুকু-৫) একথা কোথাও বলা হয়নি যে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার সময় তাঁর উপর অহী অবতীর্ণ হয়ে এর হাকীকত বিশ্লেষণ করে দিয়ে ছিল। বরং ঐ সময়ে জন্য তার মাঝে সেই জ্ঞানশক্তি আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন। এটা ঐ শ্রেণীর জ্ঞান যার সম্পর্কে কোন কোন আম্বিয়াকে শৈশব অবস্থায়ই আলীম বা জ্ঞানী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং ফেরেশতাগণ তাঁকে এক বড় জ্ঞানী সন্তানের খোশ-খবরী দান করলেন।” (সূরা যারিয়াত : রুকু-২) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং আমি তোমাকে এক বড় জ্ঞানী সন্তানের খোশ-খবরী প্রদান করছি।” (সূরা হিজর : রুকু-৪) এই আয়াতের আলীম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, আলেম শব্দটি নয়। আর আলীম শব্দটি আলেম শব্দের চেয়ে অধিক জ্ঞানের প্রতি নির্দেশ প্রদান করে। এই আয়াতসমূহের দ্বারা বুঝা যায় যে, সময় নির্ধারিত অহী যা সময় সাপেক্ষে আসে, তাছাড়া জ্ঞানের একটি সার্বক্ষণিক দান ও নবীর শানের সাথে সম্পৃক্ত থাকে যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মাঝে পরিদৃষ্ট হয়।
এলেম এবং হুকুম : অনেক আম্বিয়া সম্পর্কে এলেমের হুকুমদানের বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে। হুকুমের আভিধানিক অর্থ ফায়সালা করা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করা। উর্দু ভাষায় যার অর্থ বুঝ-জ্ঞানের ফল বলে ধরে নেয়া যায়। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী মুফরাদাতুল কুরআনে লিখেছেন, কোন বস্তুুর উপর হুকুম করা, এই ফায়সালা করা যে এই বস্তুুটি এরূপ অথবা এরূপ নয়, চাই এই ফায়সালাকে তুমি অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পার অথবা না পার। আরবী অভিধানের বিখ্যাত কিতাব ‘লিসানুল আরবে’ আছে, হুকুমের অর্থ হচ্ছে, জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ন্যায়ানুগ ফায়সালা করা। যে সকল আম্বিয়াদের উপর কিতাব নাযিল হওয়ার প্রমাণ নেই তাদেরকে এলেম এবং হুকুমদান করা হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, অহীয়ে কিতাব ছাড়া অন্য কোন উপহার এলেম এবং হুকুমের প্রতিই ইঙ্গিতবহ। সুতরাং হযরত ইউসুফ (আ:)-এর শানে বলা হয়েছে, “এবং যখন ইউসুফ (আ:) যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন আমি তাকে হুকুম এবং এলেম দান করলাম।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-৩) হযরত লুত (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “লুতকে আমি হুকুম এবং এলেম দান করেছি।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৯) আর হযরত দাউদ এবং সুলায়মান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, “সুতরাং আমি সুলায়মানকে সেই ফায়সালা বুঝিয়ে দিলাম এবং প্রত্যেককেই আমি হুকুম এবং এলেম দান করলাম।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৬) হযরত ইয়াহইয়া (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “হে ইয়াহইয়া! কিতাবকে (তৌরাত) দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং আমি তাঁকে শৈশবেই হুকুম দান করেছি।” (সূরা মরিয়াম : রুকু-১) অপর একস্থানে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলদের উপর স্বীয় নেয়ামতের কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “অবশ্যই আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব এবং হুকুম এবং নবুওত দান করেছি। (সূরা জাশিয়া : রুকু-২) এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কিতাব এবং হুকুম এবং নবুওত তিনটি বস্তু। এখানে কাহারো এ সন্দেহ হওয়া ঠিক নয় যে, এই আয়াতগুলোতে হুকুমের অর্থ হচ্ছে জাগতিক হুকুম এবং সালতানাত। প্রাচীন আরবীতে এই নির্দিষ্ট অর্থে শব্দটি কখনো ব্যবহৃত হয়নি। এটা অনারবদের প্রবচন মাত্র। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে। “সুতরাং তুমি মানুষের মাঝে সত্যসহ ফায়সালা কর।” (সূরা সোয়াদ : রুকু-৬) আরোও ইরশাদ হচ্ছে, “এবং যদি তুমি তাদের মাঝে ফায়সালা কর, তাহলে তাদের মাঝে ইনসাফপূর্ণ ফায়াসালা কর।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৬) হযরত দাউদ (আ:) এবং সুলায়মান (আ:) একটি মোকাদ্দমার ফায়সালা করেন। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানকে যখন তারা ফসলের ক্ষেতের ফায়সালা করতে ছিলেন।” (সূরা আম্বিয়া রুকু-৬) অপর এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, “এবং যে বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ কর, তবে তার ফায়সালা আল্লাহর প্রতিই সমর্পণ। কর।” (সূরা শু’রা : রুকু-২) সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, এই তিনটি কথা সূরা আনয়ামে কয়েকজন পয়গাম্বরের নাম উল্লেখ করে ব্যক্ত করা হয়েছে। “তারা ছিলেন ঐ ব্যক্তি যাদেরকে আমি কিতাব, হুকুম এবং নবুওত দান করেছি।: (সূরা আনয়াম : রুকু-১) যে সকল পয়গাম্বরের নাম উপরে তুলে ধরা হয়েছে এবং যাদের প্রতি ঐ সকল লোক বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে তারা হলেন, ইব্রাহীম (আ:) ইসহাক (আ:), ইয়াকুব (আ:), নূহ (আ:), দাউদ (আ:), সুলায়মান (আ:), আইয়্যব (আ:), ইউসুফ (আ:), মূসা (আ:), হারুন (আ:), যাকারিয়া (আ:), ঈসা (আ:), ইলইয়াস (আ:), ইসমাঈল (আ:), আল-ইয়াসা (আ:) এবং লূত (আ:)। এই আঠারটি নামের মাঝে হুকুম অর্থাৎ হুকুমত যদি পাওয়া যায়, তাহলে এর অধিকারী মাত্র দু’জন-সুলায়মান এবং দাউদ (আ:)। আর যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে ইউসুফ এবং মূসা (আ:)-কে সামিল করে নিতে পারেন। বাকী চৌদ্দটি নাম এমন সব পয়গাম্বরের যাদের রাজ্য বা সা¤্রাজ্যের সাথে কোন সম্পর্কই ছিল না। এজন্য যথার্থই হুকুম শব্দটি কুরআনের ভাষায় এর মূলও সঠিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এবং সেই শব্দের দ্বারা আল্লাহর যে উদ্দেশ্য রয়েছে, তা কিতাবের সাথে সাথে সে সকল পয়গাম্বরগণ যোগ্যতা অনুসারে লাভ করে ছিলেন। ভুলের পর্দাকে উন্মোচনের লক্ষ্যে এই আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন, কোন মানুষের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, আল্লাহ পাক তাকে কিতাব হুকুম এবং নবুওত দান করেন, তারপর সে মানুষের কাছে একথা বলে যে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার অনুগত বনে যাও, যেহেতেু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতেছিলে এবং তোমরা তা পাঠ করতে ছিলে। (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৮)
এই আয়াতে আহলে কিতাবকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে এবং যে পবিত্র সত্ত¡ার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি হলেন, হযরত ঈসা (আ:)। যদি তিনি না হন, তাহলে অবশ্যই উদ্দেশ্য হবেন রাসূলুল্লাহ (সা:)। এবং এটা ঐ সময়ের কথা যখন ইহুদীরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে মদীনার আশে পাশে এবং হেজাজে উপস্থিত ছিল। তাদের মোকাবেলায় ইসলাম ছিল দুর্বল এবং শক্তিহীন। এমতাবস্থায় যে হুকুম পাওয়ার উল্লেখ এই আয়াতসমূহে রয়েছে, তা মূলত : কিতাব এবং নবুওত সম্পর্কিত বস্তুই হতে পারে। কেননা হযরত ঈসা (আ:)- কে হুকুমত ও সালতানাতের সামান্যতম চিহ্নও দান করা হয়েছিল না। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা:)-ও বনী ইসরাঈল বিশেষ শক্তিসহ মদীনা ও হেযাজে অবস্থানকালীন সেই সা¤্রাজ্য লাভের মর্তবা লাভ করেননি। আর “সার্বিক হুকুম আল্লাহরই জন্য” এই আয়াতের গূঢ়মর্মও সেই ফায়সালা এবং আল্লাহর নিয়ন্ত্রিত বিধানই বটে। হুকুমত ও সালতানাত নয়। সুতরাং সান্ত¦না লাভের জন্য এই আয়াতের আগে পিছের শব্দাবলীর প্রতি নজর করুন, “বল, আমি আমার প্রতিপালকের স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, অথচ একে তোমরা প্রত্যাখ্যান করেছ, তোমরা যা সত্বর চাচ্ছ তা আমার নিকট নাই, কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহরই, তিনি সত্য বিবৃত করেন এবং ফায়সালাকারীদের মাঝে তিনিই শ্রেষ্ঠ।” (সূরা আনয়াম : রুকু-৭)
এসকল কারণে একথায় কোনই সন্দেহ থাকে না যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম নবুওতের মর্যাদা এবং অহীয়ে কিতাবের সাথে হুকুম করার অধিকারও লাভ করেন। যার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, কালামে আরব এবং অভিধান এবং কুরআনের সূত্রাবলী দ্বারা জ্ঞান ও মনীষা, ফায়সালা, সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা। এ জন্য রাসূলের এই শক্তি ও প্রতিপত্তির ফলসমূহও আমাদের জন্য অবশ্য করণীয়।
বক্ষ সম্প্রসারণ : ঐশী জ্ঞান ও মনীষার অপর এক মাকাম হচ্ছে ‘শারহে সদর’ বা বক্ষ সম্প্রসারণ। আরবী ‘শরাহ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, বক্ষ খুলে দেয়া, সম্প্রসারিত হওয়া, বিস্তৃতি লাভ করা, জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হওয়া, মনীষার পরিমÐল বিপুলায়তন হওয়া ইত্যাদি। এমনিভাবে বক্ষ সম্প্রসারণের ব্যবহারিক ও রূপক অর্থ হচ্ছে, বিস্তৃত জ্ঞান, জানার বর্ধিত পরিসর। বিশেষ করে ঐ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মনীষাকেও বক্ষ সম্প্রসারণ বলে বিবেচিত হয়, যা কোনও সূ² বিষয়ের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে অন্তরে বোধোদয়ের সৃষ্টি করে। যার ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে শান্তিলাভ ঘটে এবং স্বস্তির ভাব ফুটে উঠে। তার যাবতীয় সন্দেহ, সঙ্কোচ দূরীভূত হয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার ভাব জাগ্রত হয়।
‘জামহারাহ্ বিন দোরাইদ গ্রন্থে আছে, ‘শরাহ’ শব্দটি আরববাসীদের বাকধারা সম্ভূত। যেমন বলা হয়, “আমি তোমার জন্য কথাটি সম্প্রসারিত করে দিয়েছি। অর্থাৎ সেটিকে খুলে দিয়েছি। এবং আল্লাহ তার বক্ষকে খুলে দিয়েছেন ফলে তা খুলে গেছে। অর্থাৎ যখন তা পুণ্যকর্ম কবুল করার জন্য বিস্তৃত হয়ে গেছে।” (২য় খÐ : ২৪ পৃ:)
সিহাহ জাওহারীতের আছে, “শরাহ অর্থাৎ খুলে যাওয়া। তুমি বলতে পার, আমি সেই গোপন সমস্যাকে বিস্তৃত করেছি। অর্থাৎ এর বিশ্লেষণ করেছি।” লিসানুল আরবে আছে, “শরাহ অর্থাৎ খুলে যাওয়া। বলা হয় অমুক ব্যক্তি তার কথাকে শরাহ করে দিয়েছে। অর্থাৎ সেটিকে বিশ্লেষণ করেছে। বলা হয় কঠিন বিষয়কে শরাহ করেছে, অর্থাৎ সেটিকে বয়ান করেছে। যদি বলা হয় কোন বস্তুকে শরাহ করেছে, অর্থাৎ বিস্তৃত করেছে, খুলে দিয়েছে। অলঙ্কারের মাঝে যা খোলা যায়, তাহলে এর শরাহ করা হয়েছে বলা যায়। আর তোমরা এমনটিও বল, গোপনীয় বিষয়কে শরাহ করে দিয়েছি অর্থাৎ এর তফসীর করে দিয়েছি। এমন বলা হয় যে, “আল্লাহ পাক তাঁর বক্ষকে খুলে দিয়েছেন, কোনও পুণ্যকর্মের জন্য খুলে দিয়েছেন, অর্থাৎ সেটিকে সত্য গ্রহণের জন্য সম্প্রসারিত করে দিয়েছেন। সুতরাং তা সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। ইবনুল আরাবী বলেছেন, “শরাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে, স্মরণ রাখা, খোলা, বয়ান করা ও অনুধাবন করা।” হযরত মূসা (আ:) নবুওতের মর্যাদা লাভকালে দোয়া করেছিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষকে আমার জন্য সম্প্রসারিত করে দিন এবং আমার কাজকে আমার জন্য সহজতর করে দিন এবং আমার ভাষার জড়তাকে খুলে দিন, যেন মানুষ আমার কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। (সূরা ত্বাহা : রুকু-২) এই দোয়ার প্রারম্ভে হযরত মূসা (আ:) বক্ষ সম্প্রসারণের দোয়া করেছেন এবং শেষাংশে ফাসাহাত বা স্পষ্ট ভাষণের নিবেদন করেছেন। অর্থাৎ প্রথমত : সঠিক মর্ম দান করা এবং শেষত: এরজন্য যথাযথ শব্দাবলী চয়নের প্রার্থনা জানিয়েছেন। যেন তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগকে উদ্দেশ্যকারীরা সহজে বুঝতে পারে। কিন্তুু এই মর্তবা রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রার্থনা করা ছাড়াই লাভ করেছিলেন। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, “আমি কি তোমার বক্ষকে সম্প্রসারিত করে দেইনি, এবং তোমার বোঝাকে তোমার উপর হতে হালকা করে দেইনি?” (সূরা ইনশিরাহ : রুকু-১)
শরহে সদর এবং বক্ষ খোলার যে বিশ্লেষণ সহীহ হাদীসে রয়েছে এর সাধারণ পরিভাষা “শাক্কে সদর’ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় ফেরেশতাগণ আগমন করে বক্ষ মোবারক উন্মুক্ত করে তা যমযমের পানি দ্বারা ধুয়ে নিলেন। স্বর্ণের তশতরীতে ঈমান ও হেকমত ভরে নিয়ে আসলেন এবং তা বক্ষ মোবারকে পুরে দিয়ে বক্ষদেশ জোঁড়া দিয়ে দিলেন।” (সহীহ বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, মোসনাদে আহামদ) যদি এই ঘটনাটিকে এর বাহ্যিক হাকীকতের উপর প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সুস্পষ্ট কথা হচ্ছে এই যে, সীনা মোবারককে প্রকৃতই চাক করে যমযমের পানি দ্বারা পাক-সাফ করে ঈমান ও হেকমতের দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়। এই বিষয়টিকে যদি উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করাও হয়, তাহলেও এই হাকীকতটি স্বীকার করতে হবে যে, সীনা মোবারককে পরিষ্কার করার পর ঈমান ও হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়েছে। মোটকথা, বক্ষ সম্প্রসারণ-এর হাকীকত হচ্ছে এই যে, ঈমান এবং হেকমতে রব্বানী দ্বারা তা পরিপূর্ণ করা হয়েছিল।
বক্ষ সম্প্রসারণের উপরোল্লিখিত অর্থ ও মর্ম সীনা চাক ঘটনার দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে, কেউ যদি তা স্বীকার করতে প্রয়াসী নাও হয়, তবুও আল্লাহর রহমতে তার সান্ত¦না লাভের উপকরণ আল-কুরআনেই রয়েছে।
সূরা যুমারে ইরশাদ হচ্ছে, “প্রকৃতই যার সীনাকে আল্লাহ পাক ইসলামের জন্য সম্প্রসারিত করে দিয়েছেন সুতরাং সে আল্লাহর তরফ হতে এক নূরের মাঝে অবস্থান করছে।” (সূরা যুমার : রুকু-৩)(চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dr. Khan M G Mostofa ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৩:৫২ পিএম says : 0
Excellent. These issues are very informative and helpful for understanding Quran
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন