(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইসলামের জন্য সীনা খুলে দেয়ার মর্ম হচ্ছে এই যে, ইসলামের হাকীকত প্রাণবন্তরূপে তাঁর উপর এভাবে খুলে গিয়েছিল যে, ইসলামের সত্যতার পরিপূর্ণ একীন ও বিশ্বাস সাধিত হয়েছিল। এবং তিনি নিজেও এই বিশ্বাসের উপর পরিপূর্ণ সান্ত¦না লাভ করেছিলেন। এর ফলশ্রæতিতে তিনি স্বীয় মনজিলে মকসুদের প্রতিটি কদমে আল্লাহর রৌশনী লাভ করেছিলেন। এটাই হচ্ছে, ‘শরহে সদর’ বা বক্ষ সম্প্রসারণের মর্ম। এই আলোর কম ও বেশী বিভিন্ন স্তর এবং পদমর্যাদা অনুসারে হয়ে থাকে।
এ পর্যায়ে হাদীসের দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা দরকার। যার দ্বারা ‘শরহে সদর’ শব্দদ্বয়ের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে লক্ষ্যযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে এই যে, হাদীসসমূহ দ্বারা আভ্যন্তরীণ প্রমাণ উপস্থাপন এখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো, প্রথম পর্যায়ের আরবী বাক্যের দ্বারা ‘শরাহ সদর’ প্রবাদটির বিশ্লেষণ করা। (১) প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওফাতের পর আরবের কতিপয় গোত্র যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করলে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) তাঁদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। হযরত ওমর ফারুক (রা:) এসে আরজ করলেন, হে খলীফায়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) ! তাদের সাথে জিহাদ কেমন করে সম্ভব? রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলেছে, সে স্বীয় জান ও মাল আমা হতে নিরাপদ করে নিয়েছে। হযরত সিদ্দীকে আকবার (রা:) উত্তর করলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তাদের সাথে অবশ্যই যুদ্ধ করব যারা নামাজ এবং যাকাতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে। নামাজ হচ্ছে, আল্লাহর হক এবং যাকাত হচ্ছে, বান্দাহদের হক। যদি তারা বকরীর একটি বাচ্চা যাকে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জমানায় যাকাত হিসেবে দান করত তা বর্তমানে না দেয়, তবে আমি অবশ্যই তাদের সাথে যুদ্ধ করব। এরপর হযরত ওমর ফারুক (রা:) বললেন, “আল্লাহর শপথ! এই দৃঢ়প্রত্যয় ছিল না, কিন্তুু আল্লাহ পাক হযরত আবু বকর (রা:)-এর সীনাকে খুলে দিয়েছেন। পরে অবশ্য আমি জানতে পেরেছি যে, তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুয যাকাত) (২) দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনুল কারীমের বহু হাফেজ শহীদ হয়েছিলেন। এমন সময় হযরত ওমর ফারুক (রা:) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:)-এর খেদমতে এসে বললেন, কুরআনুল কারীমকে পর্যায়ক্রমে শ্রেণী বিন্যাসসহ কাগজে লিখিয়ে নেন। হযরত আবু বকর (রা:) বললেন, আমি এমন কাজ কি করে সম্পাদন করব, যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:) করেননি। কিন্তু হযরত ওমর (রা:) স্বীয় পরামর্শ উত্তম মনে করে বার বার আবেদন করতে লাগলেন। ফলে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:)-ও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন এবং বললেন, “হযরত ওমর (রা:) বার বার আমাকে বলতে ছিলেন। এমনকি এ ঘটনার বিষয়ে আল্লাহ পাক আমার সীনাকে খুলে দিয়েছেন। ফলে আমিও তা প্রত্যক্ষ করলাম, যা হযরত ওমর (রা:) প্রত্যক্ষ করেছিলেন।” (সহীহ বুখারী : কুরআন সংগ্রহ অধ্যায়) এই দুটি ঘটনার মাঝে ‘শরহে সদর’ শব্দদ্বয় নিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং নিজ মর্ম ও অর্থকে প্রকাশ করেছে যে, “এই হলো বক্ষ সম্প্রসারণ।” যাকে কুরআনুল কারীমের সূরা যুমারে নুরে রব্বানী বা নূরে বাছিরত বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে বক্ষ সম্প্রসারণের যে বিস্তৃত ভুবন দান করা হয়েছিল, তা বুঝবার আগে বালাগত বা অলঙ্কার শাস্ত্রের এই মাসআলাটি অনুধাবন করতে হবে। যখন কোন শব্দ সম্পর্কযুক্ত বাক্যাবলীর উপসর্গ এবং কর্মের সাথে সম্বন্ধ হয়ে ব্যবহৃত হয়, এর দ্বারা সুনির্দিষ্ট অর্থ ও মর্ম বুঝায়। কিন্তু এই শব্দটিই যদি উপরোল্লিখিত সম্বন্ধের শর্ত ছাড়া ব্যবহৃত হয়, তাহলে এর অর্থ হয় সাধারণ এবং আম। এর দ্বার ক্রিয়ার প্রতিষ্ঠাই প্রতিপন্ন হয়। যেমন এলেম ক্রিয়াটি কর্ম বা মফউল চায়। যে বস্তুর নাম জ্ঞান। ব্যবহারিক ভাষায় একে মফউল বা কর্ম বানিয়ে নেয়। এবং এক্ষেত্রে সেই জ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট শ্রেণীর জ্ঞান। যাকে কর্ম বা মফউল বানানো হয়েছে। কিন্তু যদি কর্মকে উহ্য রাখা হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট এলেমের পরিবর্তে অনির্দিষ্ট ও সাধারণ এলেম বুঝাবে। কুরআনুল কারীমের একস্থানে আছে : অর্থাৎ তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক অংশ সম্পর্কে জানে। (সূরা রূম) একথা সুস্পষ্ট যে, এই এলেমের সম্পর্ক একটিমাত্র বস্তুুর জ্ঞানের মাঝে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ দুনিয়ার জাহেরী জিন্দেগীর এলেম। তা আম বা সাধারণ এলেমের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। কিন্তু অপর একস্থানে আছে : অর্থাৎ যারা জানে এবং যারা জানে না। (অর্থাৎ যারা জ্ঞানী এবং যারা মূর্খ) উভয়ে কি সমান হতে পারে? এখানে একথার উল্লেখ নেই যে, কোন নির্দিষ্ট কথাটি জানে। বরং এখানে আম বা সাধারণ জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং আয়াতটির অর্থ হবে, যে সকল প্রকার জ্ঞানের অধিকারী এবং যে একেবারেই মূর্খ, এই দু’জন বরাবর হতে পারে না। বালাগাত বা অলঙ্কার শাস্ত্রের কিতাবে “যে হুকুম করে, দান করে এবং নিষেধ করে, সে বেশী হাসে এবং বেশী কাঁদে উদাহরণসমূহ দ্বারা এই অর্থেরই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই পর্যালোচনার পর, শরহে সদর সংক্রান্ত উপরোল্লিখিত উদাহরণগুলোর প্রতি নজর করুন, প্রত্যেকস্থানেই আপনি জানতে পারবেন যে, কথা বুঝার জন্য সীনা খোলা হয়েছে, এর উপর লাম বর্ণটি এসেছে অথবা চিহ্নের দ্বারা তা-ই বুঝা যায়; যেমন, ইসলামের জন্য সীনা খুলে দিয়েছে, কুরআন সংকলনের জন্য সীনা খুলে দিয়েছে, যাকাত অস্বীকারকারীদের সাথে যুদ্ধের জন্য সীনা খুলে দিয়েছে। কিন্তু হযরত মূসা (আ:) এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জন্য কুরআনুল কারীমে শরহে সদর এর কথা উল্লেখ আছে সেখানে একথার উল্লেখ নেই যার জন্য এই আম্বিয়ায়ে কেরামের সীনা খোলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে নির্দিষ্টবাবে দ্বীনের সাধারণ বক্ষ সম্প্রসারণ দান করা হয়েছিল। এর দ্বারাই সাধারণ উম্মত এবং আম্বিয়াদের মর্তবা ও মর্যাদার পার্থক্য নির্ণীত হয়। উম্মতের সাধারণ সদস্যদেরকে খাস বা নির্দিষ্ট বিষয়াবলী বুঝার জন্য শরহে সদর দান করা হয়। আর আম্বিয়ায়ে কেরামকে স্বীয় পরিমন্ডলে সার্বিক এবং সাধারণভাবে এই বস্তুু দান করা হয়। একটি সূ² বিষয়ের দিক এখানে উল্লেখযোগ্য। হযরত মূসা (আ:)-এর দোয়া এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর উপর ইহসান উভয়স্থলেই আমার জন্য এবং তোমার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত মূসা (আ:) বলেন, আমার জন্য আমার সীনাকে খুলে দিন। আর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক বলেছেন, “আমি কি তোমার জন্য তোমার সীনাকে খুলে দেইনি?” এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, আমার জন্য এবং তোমার জন্য কথা বর্ধিত করা এবং লাম অর্থাৎ জন্য-এর প্রয়োজনীয়তা কি ছিল? মুফাসসেরীনদের মাঝে ইমাম যামাখশারী এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন এই লাম তাকিদ এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ এখানে লামের অর্থ শুধু তাকিদ তামলিক নয়। বরং লাম বর্ণটি উপকার সাধনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনটি এই আয়াতে দেখা যায়-অর্থাৎ-পৃথিবীর সবকিছু তোমাদেরই জন্য পয়দা করেছি। তবে উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এই বক্ষ সম্প্রসারণের দৌলত তোমাকে তোমারই জন্য দান করা হয়েছে। অর্থাৎ জ্ঞানের চোখ খোলার জন্য, বা তোমার সাহায্যের জন্য বা তোমার উপকারের জন্য এবং জ্ঞানের সম্প্রসারণশীলতা ও বক্ষ সম্প্রসারণ স্বয়ং তোমারই সত্ত¡ার জন্য, যেন তা পরিপূর্ণ হতে পরিপূর্ণতররূপে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। তারপর সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে দ্বীনের সামগ্রিক বক্ষ সম্প্রসারণ প্রদান করা হয়েছিল। এর কোন একটি নিদর্শন ও ফলশ্রুতি তো পরিস্ফুট হবার দরকার ছিল? এর উত্তর মাত্র একটিই। তাহলো রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর যাবতীয় বাণী, যাবতীয় কর্মকান্ড, আহাদীস এবং সুনান আকারে যা আমাদের সামনে রয়েছে, এর সবকিছুই শরহে সদরের নিদর্শন ও শুভফল।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন