স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আনিসুল হক আর নেই। সাড়ে তিন মাস অসুস্থ থাকার পর লন্ডনে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নাল্লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ঢাকাকে উন্নত ও বসবাস উপযোগী করার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণা করেন। তার স্বপ্ন ছিল ঢাকাকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যা বাস্তবেই হবে ‘তিলোওমা’। এই স্বপ্নকে তিনি মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ তার ওপর বিপুল আস্থা স্থাপন করেছিল। এই বিশ্বাসে তারা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল যে,মেয়র আনিসুল হক এমন এক ব্যক্তিত্ব যার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। তার স্বপ্ন মানুষেরও স্বপ্নে পরিণত হয়। তার এই অকাল মৃত্যু তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনকেই শুধু নয়, ঢাকার লাখ লাখ মানুষকে শোকের সাগরে নিমজ্জিত করেছে। তিনি ছিলেন সৎ, স্বচ্ছ, আন্তরিক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একজন মানুষ। মেয়র হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং সেই সব কর্মসূচী বাস্তবায়নে নিরলস ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি খুব বেশী সময় পাননি। যতটুকু পেয়েছেন ততটুকুই কাজে লাগিয়েছেন। এর মধ্যেই তিনি কিংবদন্তির খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাস্তাঘাট অবৈধ দখল মুক্ত করে নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ ও মসৃণ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি কিছু অসাধ্য সাধন করেন। সাত রাস্তার মোড় থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কটি ছিল অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড। বহু বছর এই রাস্তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারণ, এর পেছনে ক্ষমতাশালীদের একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয় ছিল। মেয়র আনিসুল হক এই শক্তিশালী চক্রকে চ্যালেঞ্জ করেই রাস্তাটি উদ্ধার করেন এবং ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়ে দেন। এ কাজে কোনো শক্তি বা চাপ তাকে নমিত করতে পারেনি। একইভাবে গাবতলী মোহাম্মদপুর, মহাখালিকে বাসটামিনাল অবৈধ পার্কিং মুক্ত করেন কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে। রাস্তাঘাট অবৈধ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি রাস্তা-ফুটপাত উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এসব উদ্যোগের অংশ হিসাবে উত্তরা গুলশান, বারিধারা ও বনানী এলাকায় ১৭৬ কিলোমিটার সড়ক ২৪২ কিলোমিটার নর্দমা, ৬৯ কিলোমিটার প্রতিবন্ধীবান্ধব ফুটপাত উন্নয়নের কাজ করেন। গুলশান-বারিধারা এলাকায় বিদেশী বিভিন্ন দূতাবাস রাস্তা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছিল। তিনি বুলডোজার দিতে সে সব স্থাপনা ভেঙ্গে দেন। ৫০টি সেকেÐারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ, বিলবোর্ড অপসারণ টেন্ডার চালু, গুলশান, বনানী, বারিধারার জন্য ‘ঢাকা চাকা’ বিশেষ বাসসার্ভিস, বিশেষ রিকসা চালু তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি। যানজট নিরসনে আধুনিক বাস সার্ভিস চালু, ইউলুপ তৈরি ইত্যাদি আরও কিছু কাজ তিনি হাতে নিয়েছিলেন, যা এখন বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে।
মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে তিনি যা কাজ করেছেন সেটা সময়ের তুলনায় অনেক বেশী। তার স্বপ্নের, যা নাগরিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল, বাস্তবায়ন মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। চতুর্মুখী বাধা ও মোকাবিলা করেই তিনি এগিয়ে গেছেন এবং তার অর্জনগুলো নজির হয়ে রয়েছে। তিনি এদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত মুখ ছিলেন না। মেয়র হওয়ার আগেই তিনি ছিলেন নানা দিক দিয়ে খ্যাতিমান। তিনি একদা ছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তার উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ‘এমনই’ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। তিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ীদের নেতা। তিনি বিজিএমইএ, সার্ক চেম্বার, এফবিসিসিআই প্রভৃতি সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। তার বিরল ব্যক্তিত্ব ও নেতৃগণ তাকে ওই সব সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। উদ্যমী ও কল্যাণকামী মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন অন্যন্য ও অসাধারণ। মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে সেটা আমরা আরো বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি যা কিছু করেছেন তা অতীতে কেউ করার সাহস দেখাতে পারেনি। নীতির ব্যাপারে তিনি ছিলেন অটল ও আপোষহীন। নগর উন্নয়ন ও উন্নত নাগরিক সেবা প্রদানের যে অঙ্গীকারে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সে অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও আন্তরিক। এরকম একজন মেয়রের অকাল বিদায়ে নগরবাসীর স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। তার এই মৃত্যু মেনে নেয়া তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন।
তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা উত্তরাধিকারীর দায়িত্ব। তিনি অনেক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার কিছু কিছু তিনি বাস্তবায়ন করে গেছেন। বাকী উদ্যোগ-পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি ক্ষমতাসীন দল থেকে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় পরিচয়কে কখনোই বড় করে দেখেননি। তিনি ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের মেয়র। এই রকম উদার ও সমদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। মৃত্যু এমন এক বাস্তবতা যা অলংঘনীয়। আমরা যতই চাই না কেন, তাকে আর আমাদের মাঝে ফিরে পাবনা। তার জীবনকর্মই আমাদের মাঝে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকবে এবং অনুপ্রানিত করবে। সন্দেহ নেই, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জন্য আর একজন মেয়র নির্বাচিত হয়ে আসবেন। তিনি কেমন হবেন, আমরা কেউই জানিনা। আশা করি, তিনি যেন আনিসুল হকের মতো হন। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। আমরা যতদূর জানি, আনিসুল হকের পুত্র নাভিদুল হক যোগ্য প্রার্থী হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীরও তিনি ¯েœহধন্য। প্রার্থী হিসাবে তাকে মনোনিত করা হলে আনিসুল হকের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানানো হবে। তিনিও তার খ্যাতিমান পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার সুযোগ পাবেন। তার চেষ্টা ও আন্তরিকতা অন্য কারো চেয়ে সঙ্গতকারণেই বেশী হবে। বিশ্বে ইয়ং জেনারেশন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে এখন দ্রæত চলে আসছে। ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে যারা প্রেসিডেন্ট বা শীর্ষ ক্ষমতাধর পদে দায়িত্ব পালন করছেন তারা অনেকেই বয়সে নবীন। আমাদের দেশেও নবীনদের এগিয়ে আনতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন বলে আমরা আশা করি। ঢাকাকে নিয়ে আনিসুল হক যে স্বপ্ন দেখেতেন, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নাগরিকদের একান্ত প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা অবশ্য অবশ্যই পূরণ করতে হবে। পরিশেষে আমরা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তার পুত্র-কন্যা-স্ত্রী ও কনিষ্ঠভ্রাতা সেনাবাহিনী প্রধানসহ পরিবারের সকল সদস্যর প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন