সবার প্রিয় মেয়র আনিসুল হক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র ৩০ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লন্ডনের দি ওয়েলিংটন হাসপাতালে। তার বয়স ৬৫ হলেও তিনি ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী তরুণ। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন আনিসুল হক। টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে তিনি ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের মনি কোঠায়। ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ খ্যাতিমান। তৈরি পোষাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সফল সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি হিসেবে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আনিসুল হক। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আনিসুল হক। সমস্যা জর্জরিত ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তার আন্তরিক উদ্যোগের কারণে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল উত্তর ঢাকা। তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সড়ক দখল মুক্ত করতে তিনি যে সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোভাব দেখিয়েছেন তা ঢাকাবাসী স্মরণ রাখবে। তার নামাজে জানাযায় বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢল প্রমাণ করে তিনি মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন দেশের মানুষের হৃদয়ে তার সৃজনশীল কর্মোদ্যোগের কারণে।
আনিসুল হকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেয়া একটি বক্তৃতা ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছি। যতবারই আমি বক্তৃতাটি শুনেছি ততবারই অন্যরকম এক আবেগে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তার বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছে, তিনি তারুণ্যের প্রতীক, শিক্ষার্থীদের আইকন, তরুণ সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস। যে কোন হতাশাগ্রস্থ যুবক ও তার বক্তৃতা শুনে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার সাহস খুঁজে পাবে, আমি তা নিশ্চিত বিশ্বাস করি। তিনি বিশ্বাস করতেন, কখনো কখনো মানুষ তার স্বপ্নের চাইতেও বড়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, জীবনের সব চাইতে বড় শক্তি ছিল তার মানুষের দোয়া। আমার বিশ্বাস, তার এই বক্তৃতা যারা শুনবে তাদের মাতৃভক্তি আরও বেড়ে যাবে। আনিসুল হক পরিবর্তনের ঢেউ তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন, সংঘবদ্ধ মানুষ পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। তিনি ছিলেন প্রচন্ড আশাবাদী, আত্ববিশ্বাসী ও স্বপ্নবান একজন মানুষ। তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর প্রাক্কালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা এমনভাবে ফুটপাত তৈরি করেছি যাতে একজন অন্ধ মানুষ নির্বিঘেœ চলতে পারেন। সারাবিশ্ব থেকে লোকজন আমাদের রাস্তা ও ফুটপাত দেখতে আসবেন। শহর অনেক নিরাপদ হয়ে যাবে। ঢাকা শহর বদলে যেতে শুরু করেছে। আমি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি না কেন কে কোন কাজ করছেন তার সব আমি জানি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে চার হাজার বাস নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ৮৭টি পার্কের জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে আনছিলেন। আনিসুল হক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল লাইব্রেরির অনুকরণে মোবাইল স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। ঢাকার সর্বস্তরের নাগরিকই ছিলেন মেয়রের পরিকল্পনার ভিতরে। সবাইকে নিয়ে স্মার্ট ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা ছিল তার। ঢাকার নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ২৬টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন আনিসুল হক। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামেমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। একটি নিরাপদ আধুনিক ও নারী বান্ধব মহানগর গড়ে তুলার প্রত্যয় ছিল তার। ঢাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন আনিসুল হক। নগরীকে নিরাপদ করতে তার উত্তর সিটি এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়েছেন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দিনে-রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নাগরীকবাসীর অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়েছেন মেয়র আনিসুল হক। তার ঢাকা নিয়ে স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে নগরবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, শুনতে অভাবনীয় লাগলেও কথাটা সত্যি, মেয়র হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন আনিসুল হক। মেয়র নির্বাচিত হলে নগরের উন্নয়নে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা স্থির করে রেখেছিলেন আগেই। কত আত্মপ্রত্যয়ী, কত সূদুরপ্রসারী চিন্তা ধারার মানুষ ছিলেন মেয়র আনিসুল হক তা যেন কল্পনা করতেও অবিশ্বাস্য লাগে। ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলু বলেছেন, When a person really desire something all the universe conspire to that person to realize his dream.. আানিসুল হকের ক্ষেত্রেও মনে হয় মেয়র নির্বাচিত হওয়া থেকে শুরু করে তার সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রকৃতিই যেন তার পক্ষে কাজ করেছে। ঢাকা শহরকে নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পাওয়া মেয়র শহরের উঁচু দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে আকাশ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দর রোডে উঁচু দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে সবুজায়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। বিমান বন্দরের চারপাশে সাইকেল লেন করার চিন্তা ছিল তার। ফরাসী রাষ্ট্রনায়ক চার্লস দ্যাগল যথার্থই বলেছিলেন, রাজনীতি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা শুধু রাজনীতিকদের উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। মেয়র আনিসুল হক বড় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, অনেক কিছু তার এখতিয়ারে না থাকলেও সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব তুলে নিতেন নিজের কাঁধে। এত নিখুঁত কাজ এত নিখুঁত পরিকল্পনা আগে দৃশ্যমান হয়নি। তিনি ছিলেন আস্থা ও ভরসার প্রতীক। আনিসুল হক মানুষকে ভালবাসতেন সেজন্য তিনি মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসাও পেয়েছেন। একজন ধনবান মানুষ হয়েও তিনি ভালবাসতেন শিল্পী সাহিত্যিকদের। খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক মেয়র আনিসুল হককে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘তাকে আমার মনে হতো একজন সুন্দর মানুষ। সুন্দর মনের ভালো মানুষ, সুন্দর করে থাকেন, সুন্দর করে কথা বলেন। চারপাশের মানুষেরা সুন্দর থাকুক এটা চান। আর চান দেশটা সুন্দর হোক। তার অসুস্থতার খবর শোনার পর থেকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, এত পরিশ্রম এত মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব বোধ হয় তার মস্তিষ্কে চাপ তৈরি করে ফেলেছিল। আসলেতো তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না। সৎ মানুষ, পরিকল্পনা আছে, সাহস আছে আন্তরিক চেষ্টা আর পরিশ্রম আছে কেন তিনি পারবেন না এই ছিল তার বিশ্বাস। রাজনীতিবিদ সমালোচিত হলেও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, কিন্তু সামান্যতেই তাঁর ঘুম নষ্ট করত, আমাদের বলতেন এটা কেন হচ্ছে বলুন তো, আমি তো এই উদ্যোগ নিয়েছি।’
আনিসুল হকের কর্মজীবনের উপর গবেষণা করা উচিত বলে মনে করি। গবেষণা থেকে আমাদের তরুণ সমাজ জানতে পারবে কীভাবে একজন মানুষ নিজ প্রচেষ্টায়, কর্মশক্তি এবং আন্তরিকতায় এত উচ্চ শিখরে উঠতে পারে। আনিসুল হক ছিলেন তরুণ সমাজের রোল মডেল। তার সততা ও দেশপ্রেম তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করবে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজিদে ঘোষণা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা মৃত্যু ও জন্ম সৃষ্টি করেছেন যাতে করে এর দ্বারা তিনি যাচাই করে নিতে পারেন কর্মক্ষেত্রে কে মানুষের মধ্যে বেশি শ্রেষ্ঠ। আনিসুল হক তাঁর কর্মের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
লেখক: ব্যাংকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন