একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৭টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হবে। এসব নির্বাচনকে টেস্ট কেস হিসেবেই নিচ্ছে বিএনপি। রংপুর, ঢাকা উত্তর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিরপেক্ষতা ও আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখবে দলটি। তাদের জন্য এসব নির্বাচন অগ্নিপরীক্ষাও বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সাত সিটির এই নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করেই তারা আগামী দিনের কর্মসূচি দেবেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন ও নির্বিঘেœ ভোটাররা নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে ধানের শীষের প্রার্থীরাই বিজয়ী হবে বলে মনে করেন তারা। আর তাই আগেরবারের ধারাবাহিকতায় এবারও সব সিটি কর্পোরেশনেই জয় ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবছেনা বিএনপি। কেবল আশা প্রকাশ করেই নয়, বরং জয়ী হতে পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণ করছে রাজপথের এই বিরোধী দল। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে ঘুরেফিরে আসছে সিটি নির্বাচনের প্রসঙ্গও। ওই সব বৈঠক থেকে প্রার্থী বাছাই, সাংগঠনিক কর্মসূচির বিষয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্দেশনা। ২০ দলীয় জোট, ভাইস-চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠকে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব ভুলে দল মত নির্বিশেষে সকলকে দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুরের সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা। তবে নির্বাচিত হয়েও নগরের উন্নয়নে কাজ করার খুব একটা সুযোগ পাননি তারা। বিভিন্ন মামলায় বারবার তাদের গ্রেফতার করে কাজে বাধা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর, সিলেট ও রাজশাহী তিন মেয়রের গ্রেফতার হওয়া ও ছাড়া পেয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করার বিষয়টি এসব সিটি কর্পোরেশন এলাকা ছাড়াও সারাদেশেই আলোচিত হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে দুপুর বেলাতেই নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেন বিএনপির প্রার্র্থী তাবিথ আউয়াল। তবে ভোট বর্জনের পরও ওই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোট পান তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নন্দিত মেয়র আনিসুল হকের হঠাৎ মৃত্যুতে শূন্য হয়ে গেছে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদ। ফলে আগামী ফেব্রæয়ারির মধ্যে এই সিটিতে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্য ৫টি সিটির নির্বাচন আগামী জুনের মধ্যেই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রংপুরের সর্বশেষ নির্বাচনে প্রার্থীই দেয়নি দলটি। তবে আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রার্থীও দিয়েছে বিএনপি। তাদের সমর্থিত প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা। তাকে বিজয়ী করতে দলের স্থানীয় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও মাঠে থেকে কাজ করছেন। দলীয় কোন্দল ও মনোমালিন্য ভুলে সকলকে একসাথে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। বিএনপি আগামী নির্বাচনেও এসব মহানগরীর পাশাপাশি রংপুরেও নিজেদের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে চায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি ইলেকশন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচন গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণ করব আমরা। সরকারের আচরণ ও ইসির কর্মকান্ডও দেখব। এই ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকার ও ইসির জন্য অগ্নিপরীক্ষা বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিএনপি নেতা বলেন, জনগণ যদি নিজের ভোট নিজে দিতে পারে তাহলে বিএনপির প্রার্থীরাই বিজয়ী হবে। আর সরকার যদি কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাহলে তাদের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। আওয়ামী লীগের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে দলটি। তারা মনে করেন বিএনপি যে বলছে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ তা জনগণের সামনে প্রমাণের সুযোগ এই নির্বাচনগুলো। সরকার নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলে বিএনপির দাবির সাথে জনগণও একাত্ম হবে। এছাড়া দেশে বিদেশে বিএনপির সহায়ক সরকারের দাবিটি জোরালো সমর্থন পাবে। এছাড়া নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়েরও সুযোগ থাকছে এসব নির্বাচনে। বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনাও বেড়ে যাবে। এজন্য এসব নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি গত মাসে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য, দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সাথে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলমত নির্বিশেষে ধানের শীষের প্রার্থীর জন্য কাজ করার আহŸান জানান। নির্বাচনের আগে মহানগরীগুলোতে বিএনপি চেয়ারপারসন সফর করবেন বলেও এসব বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান। এছাড়া স্থানীয় ও শীর্ষ নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে ও সম্পৃক্ত হতে নির্দেশ দিয়েছেন বেগম জিয়া। নিজ এলাকার মানুষকে বর্তমান সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও অপশাসনের বিরুদ্ধে সচেতন ও সোচ্চার করে তোলার কথাও বলেন তিনি। নেতারা কাজও করছেন নির্দেশনা অনুযায়ী। সভা-সমাবেশে ছাড়াও নানা কর্মসূচি পালন করছে মহানগরী বিএনপি। চলছে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে বৈঠক, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও কর্মকান্ডে সম্ভাব্য প্রার্থীরা যোগ দিচ্ছেন।
বিএনপি কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, ঢাকা উত্তর, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনায় আগের প্রার্থীরাই বিএনপির পছন্দের শীর্ষ রয়েছেন। তবে পরিবর্তন আসতে পারে গাজীপুর ও বরিশালে। গত নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি, গাজীপুরে প্রফেসর এম এ মান্নান ও বরিশালে আহসান হাবীব কামাল।
তারা আরও জানান, সরকারের দুঃশাসনের ফলে জনগণ এই সরকারকে না করতে চায়। এরজন্য প্রয়োজন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। একইসাথে বিএনপির যোগ্য প্রার্থী বাছাই ও ঐক্যবদ্ধভাবে সেই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা। এজন্য সব সিটি কর্পোরেশনেই বিএনপি সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে চায়।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপি মানুষের মন জয় করেছে। বিগত নির্বাচনে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, গাজীপুর, বরিশালে জিতেছে। কিন্তু তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়নি। জেল-জুলুম করে দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়া হয়েছে। জনগণ সবই দেখেছে। এবারও আমরা জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য সব নির্বাচনে অংশ নিবো। আমরা আশা করি জনগণ এই সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ ভোটের মাধ্যমেই করবে।
দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিবে। প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। কয়েক স্তরে প্রার্থী তালিকা করা হয়েছে। ব্যক্তি নয়, রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় সবখানে প্রার্থী দেয়া হবে। সবার লক্ষ্য থাকবে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন