বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল বিভাগের রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ আইনজীবীরা। ইতোমধ্যে যে সব গ্রাউন্ডে রিভিউ করা হবে সেগুলো পয়েন্টাকারে প্রস্তুুত করা হয়েছে। যা রিভিউ শুনানিতে তুলে ধরবেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। প্রায় ১ হাজার ৪০০ শ’ পৃষ্ঠার ভলিয়মও তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিশেষ কমিটির একটি বৈঠকে রিভিউ সংক্রান্ত বিষয়টি চূড়ান্তও করা হয়। শেষবারের মতো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। গত দুই মাস যাবত ১১ সদস্যসের টিমের সদস্যরা কঠোর পরিশ্রম করে এসব কাজ করেন। এখন রিভিউ আবেদন সময়ের ব্যাপার মাত্র। চলতি মাসেই সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ দাখিল করা হতে পারে এমনটি জানিয়েছেন বিশ্বস্ত একটি সূত্রে। রায় বাতিল ও রায়ের মধ্যে উল্লিখিত অপ্রসাঙ্গিক বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে রিভিউ দায়ের করা হতে পারে বলেও সূত্র জানায়।
আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পদক শ ম রেজাউল করিম ইনকিলাবকে বলেন, সামগ্রিকভাবে আমরা (সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী) পুরা রায়টি বাতিলের প্রত্যাশা করি। কারণ যোড়শ সংশোধনী যে যুক্তিতে বাতিল করা করেছেন তা গ্রহণ যোগ্য নয়। কারণ ষোড়শ সংশোধনী নতুন কোন আইন নয়। রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, রায়ের পর থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের আপত্তি আছে। সেটা নিয়ে রিভিউ করতে পারেন এমন কথা রায়ের পর থেকে শুনিছি।
রিভিউ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম ইনকিলাবকে বলেন, প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলে আপনারা জানতে পারবেন। কবে রিভিউ হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন উত্তর দিতে রাজি হননি।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮১ দিন আগেই পদত্যাগ করেন। প্রথমে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যান। ২৮ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে ১০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সূত্রে জানা যায়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা বহাল রেখে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায় পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনার আবেদন প্রস্তুুতির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল এর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এসদস্যের এই প্যানেলে আছেন দুজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, সাতজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল। গত ১৮ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে কমিটি একটি বৈঠকে বসে রিভিউ আবেদন করার বিষয়টি চূড়ান্ত করে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ দাখিল করা হবে। রায়ে আইনের যে ব্যত্যয় ঘটেছে সেই বিষয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কারণ উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন তা রিভিউ চাইতে গেলে ওই বিষয়গুলোতে বেশি জোর দিতে হবে। রায়টিকে বিশ্লেষণ করে রিভিউ দায়ের করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ সদস্যদের(এমপি) নিয়ে মন্তব্য, বিচারকদের অপসারণে তদন্ত করার জন্য আইন করার আগেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসাসহ বিভিন্ন গ্রাউন্ড আছে। এটা প্রায় ১ হাজার ৪০০ শ’ মতো হতে পারে। অত্যন্ত গোপনীয়তা বর্জায় রেখে টিমের সদস্যরা কাজ করেছেন বলে জানা যায়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির বেঞ্চের দেয়া রায়টি প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, যার বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৩ জুলাই সর্বসম্মতিতে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিনই সংশ্লিষ্ট শাখায় রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেছিল। রায় বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব জাতীয় সংসদ পাস হয়। রায়ে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির অসাংবিধানিক, আপত্তিকর, অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ’ বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টিও একই প্রস্তাবে পাস হয়। এরপর এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রায়ের সত্যায়িত কপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। রায় ভালোভাবে পড়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই রিভিউ আবেদন করা হবে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এরপরই ওই রায় ও রায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা। এমনকি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। পাশাপাশি রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া পর্যবেক্ষণও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানান। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট অবকাশের শেষে আন্দোলনের হুমকিও দেন। চলতে থাকে নানামুখী আলোচনা- সমালোচনার। বিএনপি পক্ষ থেকে এ রায়কে ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িরত করেন। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিএনপি নেতারা রায়কে স্বাগত জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন