বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় বহাল চেয়ে (পুনর্বিবেচনা) রিভিউ শুনানি নিয়ে দুই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন আইনজ্ঞরা। কেউ বলেছেন, আপিলের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে রিভিউ শুনানি হতে পারে। আবার কেউ বলেছেন যে কয়জন বিচারপতির বেঞ্চে রায়টি এসেছে। ওই বেঞ্চেই এবং তার চেয়ে বেশি বিচারপতিরা রায় বহালে রিভিউ শুনানি হতে পারে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, রায় পুনর্বিবেচনার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সমান সংখ্যক বা বেশি বিচারপতি থাকার উদাহরণ রয়েছে। তবে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতে যে সব বিচারপতিরা রায় দিয়েছেন তারাই রিভিউ শুনতে পারেন।
গত রোববার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন করে সরকার। সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার এ আবেদন জমা দেন।
এই রিভিউর শুনানি করতে আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন মন্ত্রী ও অ্যার্টনি জেনারেল দুই ধরনের মতামত দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ শেষে আগামী ২ জানুয়ারি রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসতে পারে। রিভিউ শুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন. যে সংসদ সরকার দ্বারা গঠিত সেই সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ করার সুযোগ দেয়া হয় না। তিনি আরো বলেন, যেই দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ তারা বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বিচারপতিদের বিচার করার ক্ষমতা তারাও রাখে না। বিচারপতিদের বিচারের জন্য একটি জুডিসিয়াল কমিটি গঠন করা হয়। তারা বিচার করেন। এমনি কি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে বলে তিনি বলেন।
রিভিউ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য জানতে চাইলে সাবেক এই্ আইন উপদেস্টা বলেন, যারা আইনে শাসন বিশ্বাস করে না। তাদের কোন বক্তব্য ঠিক না। তাদের আলোচনার বিষয়ে আমি কোন বক্তব্য দিতে রাজি না। তিনি আরো বলেন, রিভিউ শুনাতি হতে পারে। লঘু পয়েন্ট গুলোতে আবেদন করতে হয়। যে কয়জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন তারাই রিভিউ শুনতে পারেন। তবে কেউ যদি মত্যুবরণ করেন তাহলে ভিন্ন কথা। যারা থাকবে তারাই শুনবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, সাত বিচারপতি বেঞ্চ রায়টি হয়েছিল। এখন ৫ জন বিচারপতি আছেন। আদালত চাইলে সেখানে রিভিউ শুনানি হতে পারে। কারণ বিচারপতিরা অবসরে যাবেন। এরপর কি রিভিউ শুনানি করা যাবে না। এটা তো হতে পারে না।
রিভিউ জমা দেয়ার পর রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আমি এই উপমহাদেশে যতগুলো মামলা দেখেছি, বিশেষ করে ভারতে, সে মামলাগুলো পাঁচজন বিচারপতি বা সাতজন বিচারপতি করেছেন। সেগুলো যদি উল্টানোর প্রয়োজন হয় বা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সমান সংখ্যক বা বেশি বিচারপতি তা করেছেন। তবে আমাদের আপিল বিভাগের রুলসে আছে -যতখানি সম্ভব হয়।
তবে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, রিভিউ শুনানিতে সাত বিচারপতি থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট রুলসে এমন কোনো কথা নেই আমার জানামতে। এমন অনেক রিভিউ আছে যেখানে অনেকেই অবসরে গেছেন কিন্তু রিভিউ শুনানি হয়েছে। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বরেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ শুনানির জন্য নতুন করে বিচারপতি নিয়োগের প্রয়োজন নেই। আপিলের বিভাগের থাকা পাঁচজন বিচারপতি রিভিউ শুনানি করতে পারবেন। অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আমি বলতে পারি নতুন বিচারপতির জন্য রিভিউ পিটিশন শুনানি বন্ধ থাকবে না। আপনারা যদি দেখেন সুপ্রিম কোর্ট রুলসে বলা আছে, যত দূর সম্ভব যে বেঞ্চ এটা শুনানি করেছিল সেই বেঞ্চই এটা রিভিউ শুনানি করবে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না নতুন করে জাজ অ্যাপয়ন্টমেন্ট দিতে হবে। পাঁচজন বিচারপতি শুনানি করতে পারবেন।
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ দেন। রায়ের মাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেয়া ওই রায়ে তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে রায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা প্রধান বিচারপতির তীব্র সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীনরা। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা গত ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। এর মধ্যে ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন বিচারপতি সিনহা। ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে হাই কমিশানারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন