সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে জাতীয় সংসদে। গতকাল প্রস্তাবটির উপর দীর্ঘক্ষণ আলোচনায় সংসদ সদস্যরা এ ব্যাপারে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে আইনমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান। এসময় তাদের অনেকে বলেন, এই ধরনের রায় দেয়ার কোনো এখ্তিয়ার আপিল বিভাগের নেই। প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন, তার বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ রয়েছে, তিনি স্বপদে থাকলে আমরা ন্যায়বিচার পাব না। কাজেই তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলোর তদন্ত করতে হবে।
সরকার ও বিরোধীদলের সদস্যরা আরও বলেন, ‘এই রায় অশুভ ও অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পাঁয়তারা, এটি বাংলাদেশকে অকার্যকর করার ও পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চক্রান্ত।’ তারা প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন, তিনি কি সামরিক শাসন আনতে চান? আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রিটে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীদেরও (একজন ছাড়া) কড়া সমালোচনা করেন। তারা এই রায় ও পর্যবেক্ষণ গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলেও দাবি করেন। কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির দুর্নীতির বিষয়টিও খতিয়ে দেখা এবং তাকে আইনের মুখোমুখি করার দাবি জানান। তারা এসকে সিনহার বিরুদ্ধে অসাসাচারণের অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, তার বিরুদ্ধে (এসকে সিনহা) অনিয়ম, দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে এসকে হিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় এ বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একাংশের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল। প্রস্তাবটির উপর সরকারি, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের অনেকে আলোচনায় অংশ নেন। পরে এটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।
মইন উদ্দীন খান বাদল তার প্রস্তাবে বলেন, “সংসদের অভিমত এই যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল এবং রায়ে জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দেওয়া অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।”
প্রস্তাবটির উপর আলোচনায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমাদের কিংবা এই সংসদকে কেউ ছোট করে কথা বললে সমগ্র জাতিকেই ছোট করা হয়। সংসদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই আমরা দুঃখিত হই। এই সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে যত্মসহকারে আমরা এই সংশোধনী এনেছিলাম, ’৭২ এর মূল সংবিধানে ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, আদালতের বন্ধু অ্যামিকাস কিউরি তারা কারা। তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী। ড. কামাল আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজে দল করেছেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আওয়ামী লীগের কেউ নন। রোকনউদ্দিন মাহমুদ হাইকোর্টে একটা আর আপিল বিভাগে আরেকটা বলেছেন। এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল, হাসান আরিফ, টিএইচ খান- এরা কারা? একমাত্র আজমালুল হোসেন কিউসি সংসদের পক্ষে কথা বলেছেন। আর কোনো লোক পাওয়া গেল না? এসব লোক দিয়ে সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। একটি পত্রিকায় সাক্ষাতকারে ড. কামাল বলেছেন-আমাদের সংবিধান শুরুই হয়েছে ‘আমরা’ দিয়ে। তিনি কি ভুলে গেছেন বঙ্গবন্ধু বলেছেন-আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না..., আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি...।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন না। বললেন প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের পরেও সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। সেখানে সুপ্রিমকোর্টের তদন্ত কমিটিতে দু’জন আর্মি অফিসার ছিলেন। সেই কোর্টের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে তুলনা করলেন! আজকে আমার অবাক লাগে, সংসদের গ্রন্থাগারে দেখলাম ১৯৫৩ সালে বেসিক প্রিন্সিপাল কমিটি গঠন হয়, সেই কমিটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রস্তাব করে। ’৫৬ এর সংবিধানেও ছিল- সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ করবে না। সেই আইয়ুব খানের আমলের কথা বলছেন প্রধান বিচারপতি! ষোড়শ সংশোধনীতে থাকা বিচারপতি অপসারণের প্রক্রিয়া তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করল। আমরা চাইলাম সবার মর্যাদা রাখতে। তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত কি একজন বিচারপতির বিরুদ্ধেও কোনো তদন্ত হয়েছে? হয়নি। বিনয়ের সঙ্গে বলি-বেশি কথা বলা ভালো না। প্রধান বিচারপতি বললেন, তাকে মিসকোট করা হয়েছে। যিন বেশি কথা বলেন তাকেই মিসকোট করা হয়। এর আগে এত প্রধান বিচারপতি ছিলেন, কেউ এত কথা বলতেন না। এর আগে টিআইবি বলেছিল- আমাদের বিচারবিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন সংবিধান প্রণয়ন করি তখন এই বিচারপতিদের অনেকে স্কুলছাত্র ছিলেন। আর এখন তারা আমাদেরকে বলছেন অপরিপক্ব, আর তারা হলেন পরিপক্ব। তিনি বলেন, দুদককে চিঠি লিখে একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে আমাদের সংসদ কর্তৃক অপসারণের প্রস্তাব অনেক বেশি যৌক্তিক ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য। আইনমন্ত্রীকে বলবো-এটাকে রিভিউতে পাঠানোর জন্য। সংসদ কর্তৃক অপসারণের প্রস্তাব অধিকতর গণতান্ত্রিক। কারণ ৪০ বছরে একজন বিচারপতিও অপসারিত হননি।
তিনি বলেন, পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বললেন- নির্বাহী বিভাগ শেষ, আইন বিভাগ শেষ, বিচারবিভাগ ডুবতে ডুবতে কোনভাবে নাক উচিয়ে টিকে আছে। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন- বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্র। নো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। বিনয়ের সঙ্গে প্রধান বিচারপতিকে বলি, কথা কম বলা ভালো। অনেক পোড় খাওয়া লোক আমরা এখানে আছি। এই রায় দিয়ে বিএনপিকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আলোচনার সূচনা করে মাইন উদ্দীন খান বাদল তার লিখিত নোটিশে বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার পর্যবেক্ষণে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত বক্তব্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের অপিরপক্ব আখ্যায়িত করেছেন। বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে আলোচনা, গুঞ্জন চলছে যা সমগ্র জাতির জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। আমরা বিশ্বাস করি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চাদর সৃষ্টি হয়েছে সংসদ, বিচারবিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ে, যাতে সংবাদপত্র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি অনেকেই যখন ব্যক্তির ও সংগঠনের জন্য নির্ধারিত লংঘনরেখা অতিক্রম করেন, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে সঙ্কট অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংসদ ব্যাপক আলোচনার নিরিখে বর্তমান অবস্থান অবসান টায়। যাতে করে অশুভ গণবিরোধী শক্তির ঘোলা জলে মাছ শিকারের প্রচেষ্টা গুড়িয়ে যায়। প্রস্তাবের উপর আলোচনায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এই রায় পক্ষপাতদুষ্ট, এখতিয়ার বহির্ভূত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই রায় সম্পূর্ণ অপ্রাসাঙ্গিক। সংসদকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আইনি পদক্ষেপে এই সংসদ বিজয়ী হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল বলেন, প্রধান বিচারপতি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি জাতির জনককে অবমাননা করেছেন। যেই দেশের আদালত জাতির জনককে খাটো করে, সেই দেশে আমরা চুপ করে থাকবো? তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। মিডিয়ায় সেগুলো এসেছে, কিন্তু প্রধান বিচারপতি এর কোনো প্রতিবাদ জানাননি। তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে এসব দুর্নীতির তদন্ত হওয়া উচিত। তার বাড়ির কথা উঠেছে। তিনি নিজের ভাইয়ের নামে বাড়ি কিনেছেন। রাজউকের তিন কাঠার প্লট পাঁচ কাঠা করেছেন। বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্ত থামানো হয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী একাধিকবার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাসায় দেখা করেছেন। এতে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণিত। তার পক্ষে ন্যায়বিচার করা অসম্ভব। একটি অপশক্তিক্তে ক্ষমতায় আনার অপপ্রয়াস এই রায়। তার জন্য উচ্চ আদালতের বিচারকরা আজ লজ্জিত, তারা মুখ দেখাতে পারছেন না। প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, তিনি শপথ লঙ্গন করেছেন। তাই তিনি স্বপদে বহাল থাকলে আমরা ন্যায়বিচার পাব না।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ৯৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে প্রথম হাইকোর্ট বাতিল করে। হাইকোর্টের রায়ে তিনজন বিচারক ছিলেন। তাদের মধ্যে বিচারপতি আশরাফুল কামাল তার রায়ে বলেছেন ‘যারা স্বাধীনতা ও সংবিধানে বিশ্বাস করে না, তাদেরকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করে সংসদ সঠিক দায়িত্ব পালন করবে। স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী কাউকে বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হবে না। আমি সংসদকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এজন্য তারা ষোড়শ সংশোধনী এনেছেন। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ যদি এই সংশোধনী বাতিল করেন তাহলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপন হতে পারে না। কারণ ২০১২ সালের পর এই কাউন্সিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। কাউন্সিল পুনঃস্থাপন করতে হলে নতুন করে আইন করতে হবে। আপিল বিভাগের অরিজিনাল জুরিসডিকশন না থাকায় তারা শুধু হাইকোর্টের রায়ের আপিল নিতে পারেন। এর বাইরে কোনো রায় দেয়ার অধিকার আপিল বিভাগের নেই।
চুন্নু বলেন, এই রায়ের পর বিএনপি এত খুশি হয়েছে। সরকারকে অনুরোধ করব, ২০১২ সালের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কোনো অস্বিত্ব নেই তা তুলে ধরেন। তাছাড়া ষোড়শ সংশোধনীতে ইম্পিচমেন্ট বলতে কিছু নেই, রিমোভের কথা আছে। এই ধরনের রায় দেয়ার ক্ষমতা আপিল বিভাগের নেই। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বিচারবিভাগের স্বাধীনতার নামে স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? এই রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গকে অস্বীকার করা হয়েছে। এই ধরনের রায় দেয়ার কোনো এখতিয়ার আপিল বিভাগের নেই। এই রায় অগ্রহণযোগ্য।
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্প্ িবলেন, কাদের পারপাস সার্ভ করতে এই অশুভ পাঁয়তারা? পাকিস্তানের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কেন তাদের এত পছন্দ? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনুসরণ করে পাকিস্তানসহ কয়েকটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্য ও ভারতকে কেন আমরা অনুসরণ করব না? প্রধান বিচারপতির কাছে জানতে চাই- আপনি কোন একক নেতৃত্বকে অস্বীকার করতে চান? ইতিহাস বিকৃতির এই চেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ কখনও মেনে নেবে না। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠা। কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এই পর্যবেক্ষণ? ওই অ্যামিকাস কিউরিরা জনগণের শত্রু। ড. কামাল প্রতারক, সুবিধাবাদী। জীবনে কোনদিন ভোটে জেতেননি। কিন্তু ক্ষমতায় বসার তার খুব খায়েশ। বর্ণচোরা আমীর-উল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদেরও একই খায়েশ। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি আপনি বাংলাদেশের মানচিত্রকে ঢেকে দিয়েছেন। আপনার রাজউকের প্লট বদল, বাড়ি বিক্রি, ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন সবই আমাদের জানা। এসব থেকে জনগণকে নিবৃত্ত রাখার একটি প্রয়াস এই রায়। এই পর্যবেক্ষণ আলট্রা ভাইরেস (নিয়মবর্হিভূত)। এই সংসদ সার্বভৌম, কারও দয়ার দান নয়। আপনারা অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পাঁয়তারা করছেন, ওই খায়েশ কোনদিন পূরণ হবে না। প্রধান বিচারপতি যেসব কাজকর্ম করছেন, তিনি বিচারবিভাগকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছেন। প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আপনি বলেছেন, বিচারবিভাগ ডুবতে ডুবতে নাক উঁচু করে কোনভাবে টিকে আছে, এই ধরনের অসত্য বক্তব্য দেবেন না। আইনমন্ত্রীকে বলবো এই রায়, পর্যবেক্ষণ ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, আদালত সংবিধানের কোনো ধারাকে সংশোধন, বিয়োজন বা পরিমার্জনের এখতিয়ার রাখে না। এর এখতিয়ার কেবল সংসদের। স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আর রক্তের চাদরেই এই সংবিধান। আইন পরিষদের কাজ আইন প্রণয়ন করা, আর বিচারপতিরা আইনের ব্যাখ্যা দেবেন। সংসদ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই। অনেক সংসদ সদস্যের ত্যাগ, অবদান, সততা ও জ্ঞানকে অস্বীকার করা সমীচীন হয়নি। প্রস্তাবের ওপর অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন- জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, স্বতন্ত্র সদস্য তাহ্জীব আলম সিদ্দিকী প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, গত ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা চলে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক শাসনামলে চালু করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত করার কথা বলা হয়।
সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। যদিও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেতারা এই রায়কে স্বাগত জানান।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, এই রায় এখ্তিয়ার বহির্ভূত। প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একখান মিটিং করে ফেললেন, এর মাধ্যমেও তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তিনি কি সামরিক শাসন আনতে চান? তিনি বলেন, অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেই বিচারপতিরা বেশি নিরাপদ থাকবেন। শেখ সেলিম বলেন, এমপি হবার যোগ্য কারা সেটি সংবিধানে বলা আছে। বরং আপনাদেরই (বিচারপতিদের) যাচাই করা দরকার। আপনি এই সংসদকে অকার্যকর বলেন কীভাবে! এমপিরা তো অনেকের মত ঘুষ খান না। প্রধান বিচারপতি আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না। রাজনীতি করার ইচ্ছা থাকলে ওখান থেকে পদত্যাগ করেন, দেখবেন জনগণ কীভাবে আপনার খায়েশ মেটায়। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা বাংলাদেশ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারাই এই ধরনের কথা বলতে পারে, অপানার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা যেতে পারে। বাংলাদেশ আপনার ভালো না লাগলে পাকিস্তানে চলে যান। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। আপনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এই রায় আপনাকেই বাতিল করতে হবে। আপনি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মত রাষ্ট্র বানাতে চান। আপনারা বিচারপতিরা বহু অপকর্ম করেছেন।
পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আজকে আমি সত্যিই দুঃখিত যে সংসদে রায় নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব আইন পাস করা, সংশোধন করা। সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবো কিনা, সেজন্যই আজ এই আলোচনা। আমরা যখন বলি সার্বভৌম, সংবিধানে প্রত্যেকটি অঙ্গকে নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারাই হল সার্বভৌম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীকে হাইকোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। তারা সেদিন আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিচারক নিয়োগ দেয় সিনেট, তাদের অপসারণও হয় সিনেটে। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদ ও রাষ্ট্রকে অকার্যকর করাই এই রায়ের প্রধান উদ্দেশ্য। সংবিধানের কোনো সংশোধনী যদি মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে আদালত সেটা দেখতে পারে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থেই সংসদ এই সংশোধনী এনেছিল। রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণসমূহ যেন এক্সপাঞ্জ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন