শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

‘সর্বোচ্চ আদালতের ভুল প্রত্যাশিত নয়’

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়-১

| প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে (বর্তমানে জাতীয় সংসদ ) এই সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছর ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকী হতে এটি কার্যকর হয়। ২০১৪ সালের ষোড়শ সংশোধনীসহ এটি মোট ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। তবে এসব সংশোধনীর মধ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সপ্তম সংশোধনী এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বাতিল করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেয়ার বিধান সম্বলিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল-২০১৪ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর বিলটি ৩২৮-০ ভোটে পাস হয়। ২২ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পর তা ঐ বছরই আইনে পরিণত হয়।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নয় জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পর গত বছর ৫ মে সংশোধনীটিকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে এ বছর ৪ জানুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা হয়।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ পক্ষে বিপক্ষে ১১ কার্যদিবসের শুনানির পর সর্বসম্মতিক্রমে আপিলটি খারিজ করে। এখানে পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রথম কিস্তি আজ প্রকাশ করা হলো ঃ
রায়
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাঃ “আমাদের ওপর আছে গোটা সংবিধানের রক্ষা কবচ। আর তাই সংবিধানের নিরাপত্তামূলক বর্ম পরে এবং উৎসাহমূলক তলোয়ারের ঝিলিক তলে আমরা এর আলোকিত পথে পরিভ্রমণ করি।”
১৯৫৪ সালে এক ভাষণে এই সুললিত বাগ্ময় অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন বিচারপতি বিভিয়ান বোস। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সুপিম কোর্টে প্রথম যে ক’জন ভারতীয় বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণ করে শপথ নেন তিনি তাদের অন্যতম। যে ঝিলিক তোলা তলোয়ারের কথা বিচারপতি বোস বলেছেন তা রয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের ফরমান, আদেশ এবং পর্যবেক্ষণ বলবত করার কথা বলা হয়েছে। এর অনুরণন মিলবে আমাদের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছেঃ
“কোন ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোন দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপীল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোন মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রী বা রীট জারী করিতে পারিবেন।”
এতে এই আদালতকে তার আওতাধীনে তার সামনে অনিষ্পন্ন যে কোন ঘটনা ও বিষয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে যেরূপ প্রয়োজনীয় সেরূপ ফরমান জারি কিংবা আদেশনামা তৈরি করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ন্যায়বিচারের ঝর্ণা যে এই সর্বোচ্চ আদালত সে বিষয়টির ওপর জোর দিতে এতে জ্ঞাতসারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রণীত কোন আইন যখন প্রকৃত ন্যায়বিচারকে বিপথগামী করে এমন কিছু বিরল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা এই আদালতের, কেবলমাত্র এই আদালতের ওপর অর্পিত হয়েছে। এটাই আমাদের সংবিধান প্রণেতারাই চেয়েছিলেন। এটাই ছিল সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি জাতির পিতার আস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের একজন বর্তমান বিচারপতি বিচারপতি স্টিফেন ব্রেয়ার তার বই ‘দ্য কোর্ট এন্ড দ্য ওয়াল্ড’-এ অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
আমাদের জাতির প্রতিষ্ঠাতারা মনে করতেন, প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নয়, বরং একদল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারক গ্রুপ থাকলে সংবিধান উত্তমরূপে কাজ করবে। প্রেসিডেন্টের কার্যাবলী এবং কংগ্রেস প্রণীত আইনসমূহ সংগতিপূর্ণ কিনা তা এই বিচারক গ্রুপই নির্ধারণ করবেন। সর্বোচ্চ আদালতের ওপর আস্থা অর্পণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনুরূপ চিন্তা-চেতনা কাজ করেছে। জনগণের প্রত্যাশা যেকোন বিষয়ের ওপর বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। ফলে বিচার কার্য পরিচালনার সময় কেবলমাত্র সর্বোচ্চ আদালতে এই ক্ষমতা সংক্ষণের কারণ বিচারকরা সব সময় মনে রাখবেন। এই শীর্ষ আদালতের বিচারকরা কেললমাত্র এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। কেননা তারা সবার উর্ধে সকলের আস্থাভাজন। তারা ভুল করবেন এটা প্রত্যাশিত নয়। অন্যকোন বিচারক, প্রশাসক কিংবা আমলা নয় বরং সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের ওপর সংবিধান এই বিশ্বাস বা আস্থা রেখেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ঝলকানো তরবারির কথা বিচরপতি বোস ভেবেছিলেন। ( এ প্রসঙ্গে বলা যায়) কোন মহলের চাপ না থাকলে অবাধে ন্যায়বিচার করা যায়। মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে এই পর্যায়ে সাংবিধানিক আইনের বিভিন্ন দিক নিূেয় আলোচনা করা প্রয়েজন।
সংবিধান কেবলমাত্র কোন দেশের জনমনে জীবন্ত থাকলেই তা বেঁচে থাকে। লিখিত সংবিধানকে মনে করতে হবে একটি জীবন্ত বৃক্ষের মত। যদিও এর মূলগুলো এরূপ কিছু বিষয়ে প্রোথিত, আর এটি এমন একটি গাছ যার শাখাগুলো সময়ের বিবর্তনে এবং একই সামাজিক গোষ্ঠীর সাধারণ আইন বিজ্ঞানের উন্নয়নের মাধ্যমে বিকশিত হতে দিতে হবে। অন্টারিও’র কিংস্টনে কুইন্স ইউনিভার্সিটির ডবিøউ জে, ওয়ালুচাউ তার বই ‘আ কমন ল থিওরি অব জুডিশিয়াল রিভিউ’-এ সংবিধানকে এমনভাবেই তুলে ধরেছেন। এ বইয়ে তিনি আইনের বিভিন্ন শাখা, দর্শন, রাজনৈতিক তত্ত¡, সাংবিধানিক মতবাদসহ ব্যাপক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। গণতন্ত্রে অনির্বাচিত বিচারকদের ভূমিকা বিশেষ করে সাংবিধানিক নীতি গঠনে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়েও এতে আলেচনা করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
তানবীর ৭ আগস্ট, ২০১৭, ১:৫৮ পিএম says : 0
এই নিউজটি করার জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন