তারেক সালমান : সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আদালতের দেয়া এ রায়কে সন্মান জানানোর কথা দলের পক্ষ থেকে বলা হলেও রায় নিয়ে ইতোমধ্যেই তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আইনী এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপেরও প্রস্তুতি চলছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে অনেক ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে দলটি সংক্ষুব্ধ। এসব পর্যবেক্ষণকে অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, আপত্তিকর হিসেবে আওয়ামী লীগ উল্লেখ করেছে। রায় ঘোষণার পর কয়েকদিন নিশ্চুপ অপেক্ষা করলেও পরবর্তিতে রায়ের বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কড়া সমালোচনা ও বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। ধাপে ধাপে করা হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন। দেয়া হচ্ছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, রায়ের সঙ্গে দেয়া পর্যবেক্ষণ অনাহুত। এর মাধ্যমে ভিন্ন অভিপ্রায় রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এর ফলে কিছু দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ে। ফলে এখানে সরকারেরও নিশ্চয়ই কিছু করণীয় থেকে যায়। চিন্তা ভাবনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এদিকে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ চেয়ে আবেদন অথবা এক্সপাঞ্জের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব আইন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলেও তিনি জানান।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ষোড়শ সংশোধনী রায় বাতিলের পর থেকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা অভিজ্ঞ আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করে যাচ্ছেন। সেসব বৈঠকে পরবর্তি করণীয় নির্ধারণ নিয়েও তারা আলোচনা করছেন। ইতোমধ্যেই এ রায়ের বিপক্ষে আইনী লড়াইয়ে নামারও ঘোষণা দিয়েছেন দলের নেতারা। স্বল্প সময়ের মধ্যে রায়ের রিভিউ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রিভিউ‘র জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের টিমও গঠন করা হয়েছে। সূত্র জানায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিল বিভাগের রায়ের বিষয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনিত না হলেও এ রায়ের সঙ্গে দেয়া পর্যবেক্ষণগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ‘মুক্তিযুদ্ধ একক নেতৃত্বে আসেনি’ রায়ের এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসীনদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছে। সে কারণে একদিকে আইনী লড়াই ও অন্যদিকে এ রায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাবে দলটি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় ও পর্যবেক্ষণে সংবিধানবিরোধী কিছু আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে টিম গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণে সংবিধান পরিপন্থী কিছু থাকলে সংবিধান অবমানার মামলা করবে এমনটিও ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত দলীয় নেতাদের সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে আরও ‘স্টাডি’ করার নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ও দলের আইন সম্পাদক এ্যাডভোকট শ ম রেজাউল করিমকে বিষয়গুলো তদারকি করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকমন্ডলীর সদস্যদের এক যৌথ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের একজন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতা বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রেসিডেন্টসহ আমরা কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নই। তাই সংবিধান স্বীকৃত সত্যকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি গত বৃহস্পতিবার ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় এ দাবি করেন। প্রধান বিচারপতি নিজ থেকে পদত্যাগ না করলে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে তার অপসারণে আইনজীবীরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে বলে জানান তিনি। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, বিএনপির সুরে কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে বেশি দিন থাকতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের এ বক্তব্যের পক্ষে প্রকাশ্যে কোনো নেতা বক্তব্য না রাখলেও তার বক্তব্যের বিপক্ষে কোনো নেতা বক্তব্য দেননি। অথবা এ্যাডভোকেট কামরুলের এ বক্তব্য তার নিজস্ব বলেও কোনো নেতা সাফাই গাননি। সে থেকে ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষুব্ধতা অনুমিত হয় বলেও সূত্র জানায়।
১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একেবারেই চুপ হয়ে যায়। দলটির পক্ষ থেকে বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করার কথা জানানো হয়। অপরদিকে, রায় ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এই রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে। একইসঙ্গে রায়কে ইস্যু তারা সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। এরপর গেল সপ্তাহের মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয়। রায়ের কয়েকটি পর্যবেক্ষণ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমালোচনা করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি দলের নেতাদের এই নিয়ে নিয়ে কথা বলার নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর গত কয়েকদিনে মন্ত্রীসহ দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বক্তব্যে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এ সময় তারা প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহারও কঠোর সমালোচনা করেন। গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও গণপূর্তমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন রায়কে কেন্দ্র করে বিচারবিভাগ ও বিচারপতিদের কঠোর সমালোচনা করেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, যারা বর্তমান সংসদকে ইম-ম্যাচিউরড বলেন, তারাই ইম-ম্যাচিউরড। যারা বর্তমানে বিচারকের আসনে বসেছেন, তারা ইম-ম্যাচিউরড। নির্বাচনের পর সারা বিশ্ব আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বিশ্বের সংসদ এই সংসদকে বৈধতা দিয়েছে। এই সংসদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার তাদের নেই। দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, কয়েকজন বেঈমান যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে, চার জাতীয় নেতাকে হত্য করেছে, তখন একটি কালো আইন করে হত্যাকারীদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। তখন কোথায় ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট, কোথায় ছিলেন বিচারপতিরা?
সভাপতিমন্ডলীর আরেক এক সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গত বুধবার সহযোগী সংগঠন যুবলীগের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশে বলেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যা বলছেন, তা ঠিক নয়। বাংলার মানুষ জানে, আপনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আপনি সাংবিধানিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, আপনাকে সংবিধান মানতে হবে। সংসদ ও রাষ্ট্রপতিকে মানতে হবে, আপনি সংবিধান মেনে কাজ করতে হবে। আপনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে নন।
এদিকে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিপক্ষে জনমত গঠনের পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এজন্য ঢাকাসহ সারাদেশে দলের সমর্থক আইনজীবীদের মাধ্যমে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা করার মধ্য দিয়ে জনসচেতনতা ও জনমত তৈরির কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া, দলের প্রচার বিভাগ থেকে শোকের মাস আগস্টের পর সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই রাজধানীতে সিরিজ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা হবে।
এরই অংশ হিসেবে গত শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায়ে পরিষদের নেতারা সংক্ষুব্ধ হয়ে তিনদিনের কর্মসূচি দেন। কর্মসূচির মধ্যে আজ রবিবার, আগামী মঙ্গল ও বুধবার (১৩, ১৬ ও ১৭ আগস্ট) দুপুরে সারা দেশের আইনজীবী সমিতিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে। একই সঙ্গে রায়ে যে সমস্ত ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে তা স্বতপ্রণোদিত এক্সপাঞ্জ করার দাবি করেছেন পরিষদ নেতারা। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস বলেন, প্রধান বিচারপতি সংবিধানের ষড়োশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাতে আইনজীবী অঙ্গনকে সংক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংসদ, অধস্তন আদালতের প্রতি রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে মন্তব্য দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্য অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে। একটি মহল রায় নিয়ে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এসব কর্মসূচি বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর দুই জন সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মনে করে, আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে দেয়া পর্যবেক্ষণ একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, পর্যবেক্ষণগুলো ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায়, সংবিধানের সঙ্গে কনফ্লিক্ট তৈরি করে। ফলে সরকার মনে করে, এটা ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন