একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ‘সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রক্রিয়ায় বিচারকরা স্বাধীন থাকবেন এবং তিনি কোনরূপ বিধিনিষেধ, অযোক্তিক প্রভাব, প্ররোচনা বা প্রলোভন, চাপ, হুমকি, কিংবা কোন মহল থেকে বা কোন কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করতে সক্ষম হবেন। বিচারকদের পক্ষপাতহীনভাবে, তাদের বিবেক ও তথ্যের ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এবং বিদ্যমান আইনের বিধান অনযায়ী মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অবাধ স্বাধীনতা থাকবে। বিচারকরা মামলার গুরুত্ব (merit) সম্পর্কে বিচার বিভাগের বাইরে কারও কাছে কোন কিছু বলতে (to report) বাধ্য নন।’ ভেনিস কমিশনের নিরপেক্ষ ব্যবস্থা (Independent System by the Venice Commission) সংক্রান্ত রিপোর্টে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।
এ কথা মনে রেখে মাসদার হোসেন মামলায় এই ডিভিশন বলেছেঃ
‘বিচার বিভাগ তার বিচারিক কার্যক্রম পরিচারনার ব্যাপারে নিজেদের প্রশাসনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন থাকবে। বিচার বিভাগকে বিশেষ করে সরকারের নির্বাহী শাখার হস্তক্সেপ কিংবা এর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করতে হবে। একে অবশ্যই কর্পোরেট জায়ান্ট, ব্যবসায়ী, কিংবা কর্পোরেট সংস্থা, প্রেশার গ্রুপ, মিডিয়া, রাজনৈতিক চাপ ইত্যাদি থেজে মুক্ত করতে হবে।’
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের মূল ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়ঃ
“৯৫ । (১) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।
(২) কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে এবং
(ক) সুপ্রীম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে, অথবা
(খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোন বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে কিংবা অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে এবং অন্যূন তিন বৎসর জেলা-বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ না করিয়া থাকিলে তিনি বিচারকপদে নিয়োগলাভের যোগ্য হইবেন না ।
(৩) এই অনুচ্ছেদে ”সুপ্রীম কোর্ট” বলিতে এই সংবিধান প্রবর্তনের পূর্বে যে কোন সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে আদালত হাইকোর্ট হিসোবে এখতিয়ার প্রয়োগ করিয়াছে, সেই আদালত অন্তর্ভুক্ত হইবে।”
সংসদের পঞ্চদশ সংশোধনীতে (২০১১ সনের ১৪ নং আইন)-এর ৩০ ধারাবলে এটি নিন্মোম্নোকক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ঃ
“৯৫। (১) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।
(২) কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে, এবং
(ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল এ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে; অথবা
(খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোন বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে; অথবা
(গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে ;
তিনি বিচারকপদে নিয়োগলাভের যোগ্য হইবেন না।
(৩) এই অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ বলিতে এই সংবিধান প্রবর্তনের পূর্বে যে কোন সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে আদালত হাইকোর্ট হিসাবে এখতিয়ার প্রয়োগ করিয়াছে, সেই আদালত অন্তর্ভুক্ত হইবে।”
উপরের তথ্যানুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, উপ অনুচ্ছেদ ২(গ) ১৯৭২ সালের মূল অনচ্ছেদে ছিল না। এটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভৃক্ত করা হয়। এটিতে কোন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণের আইনের কথা বলা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এই যে, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৯৫(২)(গ) অন্তর্ভৃক্ত করা হলেও কোন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণপূর্বক আইন পাস না করে সংসদ এটি পাশ কাটিয়ে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে। এই সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের কথা বলা হয়েছে। কেন এটা করা হলো তা বোধগম্য নয়। সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী আইন পাস করা না হওয়া পর্যন্ত কিভাবে অপসারণ প্রক্রিয়া পাস হতে পারে? প্রথমত আইনের দ্বারা কোন ব্যক্তির উচ্চতর বিচার বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগের মানদন্ড নির্ধারিত থাকতে হবে। তার পরেই সে বিচারকের অপসারণের প্রশ্ন আসবে। তবে সংসদই ভাল জানে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার চিন্তাভাবনা না করে কেন তারা অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে এগিরয়েছে। উচ্চতর বিচার বিভাগে বিচারক হিসেবে কোন ব্যক্তির নিয়োগের যোগ্যতা তথা অপসারণ প্রক্রিয়া সংবিধানে বিদ্যমান থাকা সত্তে¡্বও ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণের আগে সংসদ সুপ্রিম কোর্টের বিচরকদের অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে কেন এত আগ্রহী তা বোধগম্য নয়? মাই লর্ড প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিজ্ঞ ভ্রাতৃগণ, তাদের রায়ে সতর্কতার সাথে এ ধরণের কৌতুহল-উদ্দীপক বিষয় উত্থাপন করেছেন যার সঙ্গে আমি একমত। সুতরাং আমি এ ব্যাপারে আর কোন মন্তব্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করি না। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিয়ে একরার নিয়োগ পদ্ধতি নির্ধারিত হয়ে গেলে, ন্যায়পরায়ণতা ও নৈতিক মূল্যবোধসহ আইনশাস্ত্র ও ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী তথা বিচার কার্য পরিচালনায় দৃঢ় সংকল্প ও সাহসী, অভিজ্ঞ ও আইন সম্পর্কে পরিপক্ক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বিচারক নির্বাচিত হলে, সে ধরণের বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনা খুব কমই ঘটবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সময়ের চাহিদা অনুসারে বিচারকদের নিয়োগ নীতি ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। এটি এখন আর প্রধান বিচারপতি এবং নির্বাহী প্রতিনিধি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং উচ্চতর বিচার বিভাগে কোন বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় উদ্দেশ্যমূলক মানদন্ড (objective criteria), স্বচ্ছতা, সমান সুযোগ-সুবিধা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিক মূল্যবোধ, উচ্চ ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি বাস্তব মূল্যায়নের মাধ্যমে বিবেচনায় আনতে হবে। এটাই হতে হবে জনগণের অধিকার ও সংবিধানের সুরক্ষায় যারা যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন তেমন যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই ও নিয়োগের পদ্ধতি। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের দেশে উচ্চতর বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা আবর্তে ঘুরছে। আগের দিনগুলোতে হাইকোর্ট বিভাগে কোন বিশেষ অ্যাডভোকেট/ ব্যক্তিকে নিয়োগদানের গ্রহণযোগ্যতার বিষয় নির্ধারণের জন্য প্রধান বিচারপতি তার স্বতীর্থ বিচারকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। তারপর নিয়োগদানের জন্য সেটি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হত। কিন্তু এখন সেই পদ্ধতি/প্রক্রিয়া আর অনুশীলন করা হয় না। বরং এটি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়েছে। এখন নির্বাহী দফতর থেকে তাদের পছন্দের একটি তালিকা তৈরি করে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষায় প্রধান বিচারপতির কাাছে পাঠানো হয়, যেন প্রধান বিচারপতির কার্যালয় একটি ‘ডাক বাক্স’ (post box) । এই পদ্ধতি অনুসরণে উচ্চতর বিচার আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য খুব কমই যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া যাবে। কেননা নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা সচরাচার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে গঠিত হয়। তারা আইর্নে গভীরে গিয়ে সঠিক ব্যক্তিদের বাছ্ইা করতে পারেন না। বরং আইনজীবীর গুণাবলী ছাপিয়ে সেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অগ্রাধিকার পায়। নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার সদস্যরা নিয়মিত আদালত প্রাঙ্গনে পা দেন না। আর তাই তারা আইনজীবীদের গুণাবলী, তাদের জ্ঞান ও আইনের গভীরতা এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়কিবহাল নন। ফলে অন্যদের তুলনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান না। আইনের অভিজ্ঞতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সাহসিকতা সম্পন্ন কঠোর পরিশ্রমী আইনজীবীদের বিচারক হিসেবে বাছাই ও নিয়োগদান না করলে বিচারকদের গুণগত মান দৃশ্যত হ্রাস পাবে। সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে গুণগত মান, পক্ষপাতহীনতা, সততা ও যোগ্যতা সরাসরি জড়িত। আর বাইরের কেউ নন একমাত্র বিচারকরা এ ধরণের আইজীবীদের বাছাই করতে পারেন। কেননা বিচারকদের এজলাসে হাজির হয়ে তারা আইন পেশার চর্চা করেন। আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং ন্যায়বিচার প্রয়োগ করতে এটাই প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন