মালেক মল্লিক : উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের হাতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করছে সুপ্রিম কোর্ট। এতে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ, যা কোনোভাবেই সংশোধন করা সম্ভব নয়। সংবিধানের কিছু অসংগতি দূর না করেই, হাড়াহুড়ো করে এই সংশোধন করা হয়েছিলো। রায়ে বাতিল করা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটিও। এতে আরো বলা হয়, বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালনরত ম্যজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদের প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থি। রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, আদালত ও পার্লামেন্টের মধ্যে পারস্পারিক সম্মান ও সংহতি থাকা উচিত। আদালত বা বিচারকরা সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না মর্মে রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার রায়ের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন, পুনর্বহাল হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এখন থেকে বিচারপতিদের অপসারণে ক্ষমতা এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল।
তবে এতে খুশি নন, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, সামরিক শাসনামলের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনা দুঃখজনক। এ নিয়ে আপাতত কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আমি এই রায় পড়ার পড়ে আমার প্রতিক্রিয়া জানাব।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবিকে বলেন, সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদের প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থি রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তিনি আরো বলেন, রায়ের কপি হাতে পেলে সব বলা যাবে। তিনি আরো বলেন, তিনি (মাহবুবে আলম) তো বাংলাদেশের অ্যার্টনী জেনারেল; কাজের দু:খ পাওয়ার কি আছে। আমি মনে করি এটা বিচার বিভাগের জন্য খুবই জুরুরি ছিল। দেশে মানুষ খুশি হয়েছে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর আজি পূনাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষনে দেখা উল্লেখ করা হয়েছে, বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালনরত ম্যজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদের প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থি এমন মতামত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার। তবে প্রধান বিচারপতি সঙ্গে এক মত পোষণ করেনি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তবে ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়ে কোন মতামত দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। আর বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন উল্লেখ করেছেন, এখানে অন্য কোন ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ নেয়। এ বিষয়ে কোন কিছু বলেনি বিচারপতি ইমান আলী।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, সুপ্রিম কোর্ট আদালত বা বিচারকরা সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের বন্ধু আইনজীবীরা আপত্তি তুলেছিলেন সেগুলো এক্সপাঞ্চ করা হয়েছে। একইসঙ্গে পরস্পরের মধ্যে কী ধরনের অবস্থান থাকা উচিত, সেটি বিবরণীতে রয়েছে।
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। গত ৩ জুলাই আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হল।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ অগাস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য একজন বিচারপতি মো. ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে চলতি বছর ৮ মে আপিল বিভাগের ‘ফুলবেঞ্চে’ শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বেধীন ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু মাত্র একজন আইনজীবী। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাদের মধ্যে দুইজন মতামত দেননি।।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন