মামলা দিয়ে বিএনপিকে দমানো যাবে না -মির্জা ফখরুল
৩৫ মামলা মাথার ওপর ঝুলছে। দু’টি মামলার রায় ঘোষণা প্রায় সন্নিকটে। সারাদেশে দলের প্রায় ৮ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেত্রীদ্বয়ের অন্যতম নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তাকে নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরে চলছে নানা অপপ্রচার। আদালতের হাজিরা যতই বাড়ছে ততই যেন তিনি হচ্ছেন আরও বেশি অনঢ়, অটল ও দৃঢ়। মামলা নিয়ে বিএনপির তৃর্ণমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থাকলেও বেগম জিয়া যেন আশির দশকে পাওয়া ‘আপোষহীন নেত্রীর’ পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মামলা আদালতে হাজিরা ইত্যাদি বেগম জিয়ার মনোবলে চির ধরাতে পারেনি; বরং তিনি জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আরো হচ্ছেন অবিচল। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকালও বলেছেন, আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানের দলের গণভিত্তি এবং তাঁর আদর্শ, দর্শনকে ভয় পাচ্ছে। বিএনপিকে জনগণের কাছে মেলাইন করতে মিথ্যা অভিযোগের মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে কস্ট দিচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে সাপ্তাহে ৫ দিন প্রায় আদালতে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মামলা দিয়ে বিএনপিকে কাবু করা যাবে না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জবানবন্দি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন। অন্যান্য আসামীদের যুক্তিতর্ক চলছে। মামলার গতি অনুযায়ি এ মাসেই হয়তো তা শেষ হয়ে যাবে। এরপরই রায়ের জন্য দিন ধার্য্য করবেন আদালত। খুব শীঘ্রই এই মামলার রায় ঘোষণা হবে বলে আশঙ্কা করছেন বেগম জিয়ার আইনজীবীরা। অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যায়ে রয়েছে। এই দুটি মামলার গতির কারণে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও ৩৩টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সেসব মামলায়ও মাঝে মাঝে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে। তবে মামলা বা রায়ে তিনি ভীত নন বলে জানিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি অনঢ়, অটল ও দৃঢ় দেখা যাচ্ছে তাকে। প্রতিদিনের হাজিরাতেই তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন সরকার মামলায় ভীতি তৈরি করে বিএনপির ওপর যে চাপ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে সেই চাপে তিনি নতিস্বীকার করবেন না। একইভাবে দলের নেতাকর্মীদেরও তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে নতুন করে ১৪টি মামলা বকশীবাজারের অস্থায়ী পঞ্চম বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। দলটির নেতাদের অভিযোগ, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্যই দুটি মামলায় তাকে সাজা দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সেটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হবে। সেজন্যই তড়িঘড়ি করে মামলার কার্যক্রম শেষ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা সংসদ নির্বাচন করতে চাইছে। খালেদা জিয়া নিজেও বলেছেন, আমার মামলাগুলোয় যেন রকেটের গতি; পেছন থেকে কেউ যেন তাড়া করছে।’ খুব দ্রæত রায় দেওয়ার জন্য ‘অদৃশ্য ইশারা’ কাজ করছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের পরে কাছাকাছি সময়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায় হবে। দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ‘সাজা’ দিয়ে খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার চাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে একটা সাজার রায়, যাতে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বেগম জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, আমি নিশ্চিত, যে পরিমাণ সাক্ষ্য-প্রমাণ হয়েছে, তাতে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন। ন্যায় বিচার পাবেন। তবে মামলা নিয়ে সরকারের তাড়াহুড়া এবং সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তব্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহ-শঙ্কা তৈরি হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলা সম্পর্কে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজে চান, আগামী নির্বাচনের আগেই দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সাজা হোক। সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত- শেখ হাসিনার কথায় সেভাবেই এগিয়ে চলেছে। তবে তিনি জানান, আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করে জামিন নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে লড়তে পারবেন।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্তত ৩৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতির মামলা রয়েছে ৫টি। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে যার ৪টি। মামলাগুলো হল-গ্যাটকো, নাইকো, বড় পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলা, জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ১টি ও নাশকতার মামলা ৯টি। যে ১৪টি মামলা স্থানান্তর করা হচ্ছে তার মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে ৯টি, বিশেষ জজ আদালতে ৩টি ও ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে- দারুস সালামের নাশকতার আট মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা, যাত্রাবাড়ী থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা ও মানহানির দুই মামলা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকার সম্পূর্ণভাবে নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে এই বিচারকরা কাজ করে বলেই তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। মুক্ত মনে বিচার করার কোনো পরিবেশ নেই। এ জন্য রায় নিয়ে একটা ধারণা জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে কাজ করছি। আমি কোনো দিন শুনিনি যে, সাপ্তাহিক জামিন হয়। এর থেকে অপমানজনক আর কী হতে পারে! এ থেকে তাদের উদ্দেশ্য অনুমিত হয়।
তবে মামলার গতি ও রায় নিয়ে যতই শঙ্কা থাকুক দমে যেতে যাননা বিএনপি নেতাকর্মীরা। ভয় পাচ্ছেননা খালেদা জিয়া নিজেও। বরং তিনি এসব মামলা-রায়কে কোনভাবেই পাত্তাই দিতে চাননা। প্রতিদিন হাজিরাতে তাকে অনঢ় ও অটল মনে হচ্ছে। যা দেখে নেতাকর্মীরাও বেশ সাহস পাচ্ছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে কোন রায় তারা রাজপথে থেকে মোকাবেলা করারও ঘোষণা দিয়েছেন। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সব ষড়যন্ত্রই রাজপথে মোকাবেলা করা হবে বলেও জানান। তিনি এজন্য দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে সরকারি অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছে সরকার। তবে তা কোনভাবেই সফল হবে না। বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত আছে।
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বেগম জিয়ার ‘সাজা’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে বিশেষ আদালতে নিজের ‘সাজা’ হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া নিজেই। কয়েকজন নেতা মনে করেন সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দেওয়ার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না। কারণ এতে সরকারের পতন নিজেরাই ত্বরান্বিত করবে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করা হলে দেশে আগুন জ্বলবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেন, আন্দোলনের মুখে সারাদেশের রাজপথ বন্ধ হয়ে যাবে। হাসিনার কথায় বাংলাদেশ চলবে না। খালেদা জিয়ার কথায়, তারেক রহমানের কথায় বাংলাদেশ চলবে।
দলের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু বেগম খালেদা জিয়াকেই নয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকেও সাজা দিতে পারে সরকার। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। তবে বেগম খালেদা জিয়া তার মামলার রায় বা সাজা নিয়ে চিন্তিত নন বলে তিনি নিজেই বলেছেন। দলটির সিনিয়র নেতারাও বলছেন জীবনের শেষমুহুর্তে এসে বেগম জিয়া তার মামলার বিষয়ে চিন্তিত নয়। তিনি ন্যায় বিচার পাবেন বলে নেতারা প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। আর বেগম জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হলে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে ২০ দলীয় জোট সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন জোটের নেতারা। কারণ বেগম জিয়াকে ছাড়া তারা কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। দলের নেতারা বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত নিবেন বেগম খালেদা জিয়া। তার মামলার রায় দেখে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে আইনের মাধ্যমে সাজা দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায় সরকার। কিন্তু খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য করলে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মতুর্জা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা আগামী নির্বাচনে যাবেন না। এমনকি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওই নির্বাচন হতেও দেবেন না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তিনি জীবনের শেষ মুহুর্তে এসেও গণতন্ত্রের জন্য লড়ছেন। তাকে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবেনা। তিনি সহ আমরা দলের নেতাকর্মীরা মামলা আর জেলের ভয় করিনা। নির্বাচনে অযোগ্য করার ষড়যন্ত্রও কাজে আসবে না। আমরা জনগণের সাথে ছিলাম এবং আছি। জনগণও বিএনপির সাথে আছে। বেগম জিয়া ন্যায় বিচার পেলে নির্দোষ প্রমাণিত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন