আগামী ছয় মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই মূল্যস্ফীতির এই চাপ সহনীয় মাত্রায় রাখাতে ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে অভ্যন্তরিণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রেখে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে; যাতে বাজেটে প্রক্ষেপিত ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। তবে ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ ও আমানত অনুপাত যোক্তিকীকরণ মাত্রায় নামিয়ে আনতে সতর্কমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আগামী ছয় মাসের নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির।
গত কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণ বাড়ছে অস্বাভাবিকহারে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ বছরে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। আর নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধির হার ১৯ শতাংশের বেশি ছিল। অথচ চলতি মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত এই ঋণপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই মুদ্রানীতিতে প্রক্ষেপিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি বেশি হয়ে পড়ায় এর লাগাম টানতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের ঋণ ও আমানত অনুপাত যৌক্তিক মাত্রায় নামিয়ে আনার মাধ্যামে বেসরকারি ঋণের এই লাগাম টানা হবে। এজন্য ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে নির্ধারণ ও অভ্যন্তরিণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ ধরা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে তা দশমিক ৬ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অস্ত্রই হচ্ছে ব্যাংকের ঋণপ্রদান ক্ষমতা খর্ব করা। আর এডিআর রেশিও কমানোর মাধ্যমে ব্যাংকের এই ঋণ প্রদান ক্ষমতা কমানো হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা (এএলএম) সার্কুলার অনুসারে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো আমানতের ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৮৮ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে (বিনিয়োগ) প্রদান করে থাকে। তবে ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি, সার্বিক তারল্য, শ্রেণীকৃত ঋণের অবস্থাসহ অন্যান্য আর্থিক সূচক বিবেচনায় নিজস্ব স্ব স্ব পরিচালনা পরিষদের অনুমতিক্রমে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ৮৫ শতাংশ ও ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসাবে প্রদান করতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু ব্যাংকের দুর্বল মূলধন ভিত্তি, শ্রেণীকৃত ঋণের হার ক্রমবর্ধমান এবং লিক্যুইডিটি কভারেজ রেশিও (এলসিআর) ও নেট স্টাবল ফান্ডিং রেশিও (এনএসএফআর) এর মাত্রা ক্রমহ্রাসমান হওয়া সত্তে¡ও সম্প্রতি সময়ে তাদের এডিআর সর্বোচ্চ গ্রহনযোগ্য মাত্রা অতিক্রম করেছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে এডিআর যৌক্তিক মাত্রায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত নির্দেশিত মাত্রায় যৌক্তিকীকরণ করা হবে। তবে এই অনুপাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আগামী জুন মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হবে। তবে কোন ধরনের ব্যাংকে এডিআর হার কত হবে তা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে বলে জানান গভর্নর। তিনি আরো বলেন, আমরা ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডি রেশিও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের জন্য একটি গাইড লাইন মেনে করি। এবারও সেই গাইড লাইন মেনে এই রেশিও নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা, এনপিএলসহ (নন পারফরমিং লোন) বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তা নির্ধারণ করা হবে।
এদিকে, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও বর্তমানে বেসরকারি ঋণের প্রবাহ এই লক্ষ্যমাত্রারও অনেক বেশি রয়েছে। এতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে। চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১২ শতাংশ। তবে গত ছয় মাসে সরকারি ঋণ নেওয়ার গতি মন্থর হওয়ায় নতুন মুদ্রানীতিতে তা কমিয়ে ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আর এ দুটির ভারসাম্যের জন্য অভ্যন্তরিণ ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে গভর্নর বলেন, অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগানের বেসরকারি খাতের অংশের প্রবৃদ্ধি আগেকার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ মাত্রার চেয়ে উচ্চতর ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে প্রক্ষেপিত হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার কমে যাওয়ায়’ বেসরকারি খাতের জন্য ঋণপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরতের বিষয়ে জানতে ফজলে কবির বলেন, মোট চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফেরত এসেছে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এর বাইরে ৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত আসার বিষয়ে আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তিনি বলেন, এক দশমিক ২ মিলিয় ডলার (১২ লাখ ডলার) বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আসার চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া আরও ছয় মিলিয়ন ডলার আসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এই ছয় মিলিয়ন ডলার আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির একটি দল আজ রাতে (সোমবার) ফিলিপাইনে যাচ্ছে।
নতুন ব্যাংকের অনুমোদনে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, নতুন ব্যাংক আসা বন্ধ করার কারণ নেই। তবে আমি এটা বলছি না যে, নতুন ব্যাংক আমরা হঠাৎ করে ইউটার্ন করে নিচ্ছি। তা মোটেও নয়। আমরা সেটা অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবো।
গভর্নর বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি আমরা দেখি বা বোর্ড যদি মনে করে সেটা হবে না, তবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা কোনোভাবে রোধ করা যায় না।
ফজলে কবির বলেন, চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকের অবস্থা খুব ভালো যাচ্ছে না। দুই একটা ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। অনেক সময় মার্জারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই।
দুর্দশাগ্রন্ত ব্যাংকগুলোকে মার্জ করা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ প্রসঙ্গে ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকগুলোর মার্জারের বিষয়টি তাদের অপশন। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইন অর্থাৎ দেশের বিদ্যমান আইনে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু করার নেই। বা সরকার থেকে করার কিছু নেই। তিনি বলেন, কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংক মার্জ হবে সে সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। তারা চাইবে মার্জিং এর জন্য। এখনো এটার ক্ষেত্রে অন্য কোনো আইন নেই।
কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। মূলধনের অপর্যাপ্ততা হয়েছে। কিছু বোর্ড বা মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এ ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, মালিকানা পরিবর্তন তো হতেই পারে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিজনেসের স্বাভাবিক নিয়ম। একজন মালিক তার শেয়ার অন্যজনের কাছে বিক্রি করতেই পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন