ফজলে রাব্বী দ্বীন
আমাদের ক্লাসের একজন সুপরিচিত ছাত্র বিচ্চু। খটখটে চেহারার বিচ্ছুটা এমন কিছু নেই যা সে পারে না। দৈনন্দিন উদ্ভট সব কীর্তি করে সারা স্কুলে রীতিমত বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। সেদিনকে আমাদের ক্লাসে ক্যাপ্টেন নির্বাচন করতে বাংলা স্যার এল। বাংলা স্যার এসেই ঘোষণা দিলেন, ‘যে যে ক্যাপ্টেন হতে রাজি দাড়িয়ে পড়’। ঘোষণা শোনার সাথে সাথে প্রথম সারিতেই দাঁড়িয়ে পড়ল হাস্যরসিক মশাই। তারপর আরও পাঁচ জন দাঁড়িয়েছে দেখে ভোটাভোটির ব্যবস্থা করা হল। প্রত্যেকেই আমরা নিজ দায়িত্বে খাতার পাতা ছিঁড়ে পছন্দ জনের নাম লিখে ভোট দিলাম। তারপর সকল কাগজগুলো একটা বাক্সের ভেতরে উঠানোর দায়িত্ব পেল বিচ্চু। স্যারের হুকুম মতে সেই বাক্সটা অফিসে গিয়ে রেখে এল সে। তারপর ক্ষাণিক বাদেই স্যার যখন অফিসে গিয়ে আবার ক্লাসে ফিরে আসলেন তখন কাক্সিক্ষত ক্যাপ্টেনের নামটা ঘোষণা করলেন। এলো চুলের মাথাটা প্রথমে নখের সাহায্যে কিছুক্ষণ চুলকিয়ে নিয়ে ফটাস করে বলে দিলেন বিচ্চুর নামটা। বিচ্চুর কথাটা শুনেতো আমাদের সবার চক্ষুই চড়কগাছ। এ কি করে সম্ভব! আমরা তো সবাই ভোট দিয়েছি শিমুলকে। তাহলে বিচ্চুটা কি করে পার হল? সবার চিৎকার আর চেঁচামেচি শুনে স্যার রেগেমেগে বললেন, ‘তোরা সবাই যেমন এক বিচ্চুকেই খালি ভোট দিয়েছিস তেমনি আজ থেকে তার প্রত্যেকটা কথাই তোদের শুনতে হবে। কেউ যদি একটু উল্টা-পাল্টা করছিস তো একটা মারও আর মাটিতে পড়বে না। এই বলে দিয়ে গেলাম!
বাংলা স্যারের এমন তেজি ভাষণ শুনেতো আমাদের সবার দশের কোঠা থেকে শূন্যের কোঠায় নামার মতো অবস্থা! তারপরও সকল শঙ্কা ভুলে এ বিষয়গুলি তদারকিতে নেমে গেলাম। কি করে সে ভোট না পেয়েও ক্যাপ্টেন সেজে গেল!
বিচ্চুর সব থেকে কাছের বন্ধু গদাই কে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম বিচ্চুটার কাছে। স্কুল ছুটির পর তাকে গিয়ে বলল, ‘কিরে বিচ্চু, আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাকে তো বল্লিইনা কি বুদ্ধি করে তুই ক্যাপ্টেন হলি?’
-আরে পাগলা, ক্যাপ্টেন হতে পুষ্টিকর ঘিলু লাগে। ঠসঠসে মাথা দ্বারা এসব করা যায় না রে!’
-সবইতো বুঝলাম। কিন্তু কি করে এত সব কা- ঘটালি?
-শুন, সব বলছি। যে বাক্সের ভিতর ভোটগুলো সব তুলতে আমায় বলেছিল আসলে সেই বাক্সের ভিতর সব ভোটগুলো স্যারের অফিসে পৌঁছে দেয়ার আগেই বাহিরে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। তারপর বাড়ি থেকে নিজের নামে লিখে আনা অনেকগুলি কাগজ সেখানে ভরে দিয়েছি। ব্যাস্ যা হবার তাই হল।’
বিচ্চুর মুখ থেকে সকল কথা শুনে একটা কথাও আমাদেরকে জানাতে বাদ রাখল না গদাই। কিন্তু তখন আর কি করা! ততক্ষণে যা হবার সব শেষ হয়ে গেছে।
পরদিন স্কুলে এসে ক্লাসে ঢুকেই দেখি আমাদের জ্ঞানী মশাই এক্কেবারে স্যারের চেয়ারে বসে মূল্যবান বক্তব্য দিচ্ছে আর সবাই হা করে তা শুনছে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলছে, ‘তোমরা কি জান, তোমাদের এই বুদ্ধিমান ক্যাপ্টেন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে?’
বিচ্চুর কথায় সমস্বরে আমরা উত্তর দিলাম, ‘না না বিচ্চু!’
-হা হা হা..আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদেরকে বিদেশে ভ্রমণ করাতে নিয়ে যাব। যা এর আগে কখনও কোন ক্যাপ্টেন কল্পনাও করে দেখেনি।
সটাৎ করে জগু দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্নের সুর ধরল:
-কোন দেশে গো ক্যাপ্টেন?
-কোন দেশে বলে এখানে কোন কথা নেই। আমরা যাব ফ্লাইটে করে সোজা বিদেশে।’
-অন্য কোন দেশ না হলে বারবার তাহলে বিদেশে যাবে বলছ কেন?
-এই তুই কি রে? আগেতো এত্ত বোকা ছিলি না। এত করে বলছি বিদেশ যাব তারপরও বলছিস কোন দেশ!
অট্টহাসিতে মুখটা সবার ভরে গেলেও কেউ আর প্রাণ খুলে হাসতে পারলাম না। ক্যাপ্টেনের বাধ্যতামূলক আদেশে দুদিনের মধ্যে প্রত্যেককেই ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হল। পরদিন সবাই স্কুলে এসে একটা আজব খবর শুনতে পাই। বিচ্চুর এই ভ্রমণের উদ্যোগ নাকি স্যারেরা পর্যন্ত জানে না। তাহলে সবার কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা উঠিয়ে সে কি করল? উত্তরটা বিচ্চুর মুখ থেকে শুনার আগেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম সবাই। তৎক্ষণাৎ দৌড়ায়ে তাকে ধরে আচ্ছামত গণধোলাই দিয়ে দিলাম। তারপর বেহুশ অবস্থায় যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হল সেই সময় আমরা আসল ঘটনাটা জানতে পারি। আসলে সেদিনকে বিচ্চুটা আমাদের কাছ থেকে চাঁদার অনেক টাকা তুলে গরীব ছাত্রদের জন্য স্কুলড্রেস কিনে দিয়েছিল। যা তার মুখ থেকে শুনার আগেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছি।
তবে আমাদের ক্যাপ্টেনের মনে যে এই রকম সত্যিকারের ক্যাপ্টেনগিরি লুকিয়ে আছে তা কি আর আমরা আগে জানতাম..!
--
চকপাঠক, শেরপুর সদর, শেরপুর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন