শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সোনালি আসর

গেছোভূত মেছোভূত

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কা ম রু ল আ ল ম কি র ণ : আমি সেবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। লেখাপড়ায় অনেকটা মধ্যম মানের ছাত্র ছিলাম, তবে দুষ্টমিতে পাড়ার ছেলেদের মধ্যে এক নম্বর ছিলাম কিনা জানি না, সবাই আমাকেই নেতা হিসেবে দেখতো।। আমরা ভূতকে ভয় পেতাম। তবে বড়দের কাছ থেকে ভূতের গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। আমাদের পাড়ায় মাঝে মধ্যেই ভূতের না হোক পেত্মীদের খপ্পরে পড়ে বাড়ির বৌ-ঝিরা অসুস্থ হয়ে কী সব আবোল-তাবোল জপতো; আর আমরা তা দেখার জন্য ঐসব বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাতাম। এসব ক্ষেত্রে ওঝা-বৈদ্যদের অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে খুবই আশ্চর্য হতাম। তবে ভূত পেত্মীর অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে তখনও সন্দিহান ছিলাম না। বাজার থেকে রাত্রি বেলা যখন বাড়ি ফিরতাম তখন ঝোপঝাঁড় আর গাছপালায় ঘেরা বড় কড়ই গাছের নিচে আসলে শরীরটা ভয়ে কেমন যেনো কাঁটা দিয়ে উঠতো। আমাদের বাড়ির সামনের কবর স্থানের পাশ দিয়ে অন্ধকার রাত্রে কতবার যে ভয়ে জড়োসড়ো হয়েছি তার ঠিক নেই। রাত্রিবেলা এ জায়গাটায় আসলে মনে হতো কী যেন আমার শরীরে ভর করেছে, এই বুঝি আমাকে তুলে নিয়ে কেউ ঘাড়টা মটকে দিবে।
সেইবার এক কান্ড ঘটে গেল। আমাদের সামনের বাড়ির জলিল চাচার সাথে দুই ভূত নাকি রীতিমত বেয়াদবি করে বসলো। বাজার থেকে রাত্রিবেলা ফেরার পথে তার হাত থেকে দুটি ইয়া বড় ইলিশ মাছ কেড়ে নিয়ে গেল। শুধু তাই নয়, জলিল চাচার গায়ে নাকি এক গেছোভূত মূত্র ছিটিয়ে ভয়ও দেখিয়েছিল, আর তাতে জলিল চাচা এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে তিনদিন ধরে তিনি শয্যাসায়ী ছিলেন। আমাদের কাছে সব খবরই চলে আসতো।
আমরা পাড়ার বড়দের কাছে মাঝ মাঝেই দুই ভূতের গল্প শুনতাম। আমাদের গ্রামের পাশে বটতলীর হাটে প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবারে হাট বসতো। হাটের কাছাকছি রাস্তাটির দু’পাশে ছিল খুব গাছপালা এবং দু’পাশে সাত আটটি বাঁশঝাঁড় থাকাতে দিনের বেলায়ও এ রাস্তা দিয়ে একা হাঁটলে ভয় ভয় করতো। আর এখানেই নাকি বাস করতো গেছোভূত আর মেছোভূত। এই ভূত দুটি ইতোমধ্যে অনেক হাট ফেরত পথিকের কাছ থেকে মাছ বিশেষ করে বড় সাইজের ইলিশ, রুই কাতলা, বোয়াল, আইর প্রভৃতি মাছ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তারা কখনও মলা ঢেলা বা ছোট চিংড়ি মাছ নিয়েছে বলে কখনও শুনিনি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেকটা রহস্যজনক মনে হত।
আবারও ভূতের ইলিশ মাছ ছিনতাই তাও আবার জলিল চাচার মত এরকম বুদ্ধিমান লোকের কাছ থেকে ব্যাপারটা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না, আমরা তিন বন্ধু তাই জলিল চাচার বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করলাম। আমরা আসার খবর শুনে জলিল চাচা ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। আমাকে দেখে কিনা জানি না, জলিল চাচা নিজে থেকেই ভূতের মাছ ছিনতাই কাহিনী বর্ণনা শুরু করলেন।
‘দেখো চপল, আমি কিন্তু ভূত টুত একেবারেই ভয় পাই না। অনেকদিন গভীর রাতে বড় বাজার থেকেও একা একা ফিরেছি, ভূত টুততো কোনদিন চোখে পড়েনি। তা হলে কি, আমাদের এই বটতলীর হাটে অনেক দিন পর বড় সাইজের কিছু ইলিশ মাছ উঠেছে, তা দেখে লোভ সামলাতে পারছিলাম না। দুটি প্রমাণ সাইজের ইলিশ কিনে বাজার থেকে একা একাই ফিরছিলাম। ঐদিন সাথে করে টর্চ লাইট নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম।’ জলিল চাচা এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিলেন।
‘আরে চাচা বলুন, তারপর কি হল? আপনি যখন করিম মাঝি আর রহিম শেখের বাড়ির মাঝামাঝি এলেন, তখন কি হল?’ আমাদের বন্ধু শিপন চাচাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল।
‘সে কথাই বলছি। আম যখন বাঁশঝাঁড় ওয়ালা দু’বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম, তখন কে যেনো আমার পেছন থেক পাঞ্জাবি ধরে টান দিলো। আর আমি পেছন ফিরতেই একেবারে উধাঁও হয়ে গেল। মনে করলাম আমারই ভুল। কিছুক্ষণ পর বড় কড়ই গাছটার উপর থেকে আমার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো পানি পড়তে লাগল, আমার মাথাটা প্রায় ভিজেই গেল। আমি প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে গেলাম। গেছো ভূতটাকি তাহলে আমার মাথায় প্রশ্রাব করে দিলো নাকি। ঐদিন অমাবশ্যার পরের রাত হওয়ায় পুরো রাস্তাটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার খুব ভয় করছিলো, এই বুঝি ভূত দুটো আমার ঘাড় মটকে দেয়!’ আমি চাচাকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম, ‘তা ভয়ের কি আছে এখানে তো আর তারা আসছে না, আপনি নির্ভয়ে ব্যাপারটা খুলে বলুন এই ভূত রহস্য আমরা আবিষ্কার করবই।’
‘তা যা বলছিলাম, আমি ভয়ে ভয়ে একটু এগুতেই কে যেনো হ্যাচকা টান দিয়ে আমার ডান হাতে থাকা ইলিশ মাছ দুটির একটি কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো। আমি একেবারে ব্যাকুব বনে গেলাম। আমি ছায়ার মতো কিছু একটা দৌড়ে যেতে দেখলাম। সেই সাথে পাশের ঝোঁপ থেকে একটা কালো বিড়াল বের হতে দেখলাম।’
জলিল চাচার মুখে এ পর্যন্ত শুনে আমরাও অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম। ঐ রাস্তা ধরে আমরাও কতবার অন্ধকারে বাড়ি ফিরেছি তার ইয়ত্তা নেই। দিনের বেলায়ও ঐ পথটা অন্ধকার থাকে। তবুও চাচাকে সাহস দিয়ে বললাম, ‘চাচা ভূত টুত কিছু না মনে হয় ঐ কালো বিড়ালটাই আপনার মাছটা কেড়ে নিয়ে পালিয়েছিল।’
‘আরে না, এত বড় মাছ নেয়া ঐ পুঁচকে বিড়ালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার হাতের বাকি মাছটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম, কিছু দূর এগুতেই আরেক কান্ড, কে যেনো হ্যাচকা টানে আমার হাতের বাকি যে মাছটা ছিল সেটিও কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো। আমি ছায়ার মতো কাউকে ঝোঁপের ভেতর ঢুকতে দেখলাম। আমার অন্তরাত্মা একেবারে শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। আমি রাস্তার পাশে পড়ে গেলাম। পাশের বাড়ির জমির শেখ টর্চ লাইট নিয়ে ফিরছিল, সেই আমাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।’
জলিল চাচার কাছে ভূতের এ গল্প শুনে আমাদের মনে গেছো ভূত ও মেছো ভূত সম্পর্কে ভীষণ সন্দেহ হলো। ভূত দুটি একই পদ্ধতিতে সবার কাছ থেকে মাছ কেড়ে নিচ্ছে- প্রথমে বড় কড়ই গাছ থেকে মাথার উপর পানি ফেলা তরপর অন্ধকারে মাছ হাতিয়ে নেয়া এবং নিঃশব্দে কেটে পড়া মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আমি আমার বাহিনীকে নিয়ে একটা গোপন বৈঠকে বসলাম। সিদ্ধান্ত হলো, গেছোভূত ও মেছোভূতের রহস্য অবশ্যই উদ্ঘাটন করা হবে। আমি শিপন, চমক ও তমাল সামনের রোববার হাটের দিনটাকেই টার্গেট করলাম। আমাদের চারজনের জমানো টাকা থেকে দুটি ইলিশ মাছ কেনার সিদ্ধান্ত হলো। সেই সাথে তমালকে দুটি টর্চলাইট সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হল। আর আমার উপর দায়িত্ব পড়লো দুটি মোটা রশি সংগ্রহের।
শিপন ছিলো আমাদের চেয়ে বয়সে বড় এবং অনেকটা সাহসী। তাই হাটের দিন শিপনকেই দায়িত্ব দেয়া হলো মাছ কেনার এবং রাত নয়টার দিকে মাছ নিয়ে হাট থেকে ফেরার। আমি চমক ও তমাল আগে থেকেই করিম মাঝির বাড়ির কাছের ঝোঁপের মধ্যে টর্চলাইট নিয়ে উৎপেতে বসে থাকলাম। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে আটটা বাজে। আমরা আমাদের সামনের করিম শেখের বাড়ির ঝোঁপ থেকে দু’জন লোকের কথোপকথন পরিষ্কার শুনতে পেলাম।
‘আজকে বোধ হয় আর হবে না। সব ব্যাটারাই টর্চলাইট নিয়ে যাচ্ছে।’ একজন খুব আক্ষেপ কর বললো। ‘তা তুই পানির বোতল নিয়ে গাছে উঠছিস না কেন?’ জবাবে আরেকজন বললো। এদের কথা শুনে আমাদের কাছে ভূতের মাছ চুরির ব্যাপারটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। চমক এদের কথা শুনে বললো, চল ব্যাটাদেরকে এখনই ধরে ফেলি। আমি ওর কথায় সায় দিলাম না। মাছ চুরি অবস্থায় হাতেনাতে ধরাটাই সবচেয়ে ভালো।
একটু পর অন্ধকারের মধ্যেই খালি শরীরে লুঙ্গিপড়া একজনকে বড় কড়ই গাছটাতে উঠতে দেখলাম। আর গাছটির গোরাতেই আরেকজন কালো একটা গেঞ্জি এবং কালো হাফপ্যান্ট পড়া দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল। ব্যাটা মেছো ভূতটা বোধহয় মাছ আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। আমাদের ভেতর তখন টান টান উত্তেজনা আমরাও শিপনের মাছ নিয়ে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। ঠিক পৌনে নয়টার দিকে শিপন দড়ি দিয়ে বাঁধা দুটি ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরছিলো। অন্ধকারের মধ্যেও আমরা বেশ টের পাচ্ছিলাম। কড়ই গাছের গোরায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এবার বিড়িটি ফেলে গাছের উপরের লোকটাকে কী যেন বললো। আমরাও প্রস্তুত। শিপন কড়ই গাছের ঠিক নিচের রাস্তায় আসা মাত্রই গাছের গোরায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি রাস্তার দিকে এগুতে লাগলো। আমরা লক্ষ্য করলাম, কড়ই গাছের উপর থেকে বৃষ্টির পানির মতো কয়েক ফোঁটা পানি পড়তে লাগলো। এটা ঠিক ঐ গেছোভূতটার কাজ। আমরা তিনজন এবার কথিত মেছোভূতটাকে অনুসরণ করলাম। সে শিপনের হাতে থাকা ইলিশ মাছ কেড়ে নেয়ার মতলবে এগুতে লাগলো। আমরাও ঐ বদমাশটার পিছু নিলাম। শিপন একটু এগুতেই লোকটি পেছন থেকে শিপনের জামা ধরে টান দিয়ে ভয় পাইয়ে দিয়ে পাশের ঝোঁপে লুকাতে গেল। আর যায় কোথায়! আমরা তিনজন ওই কথিত মেছোভূতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চমক এবার টর্চ মেরে ওর মুখ খানা দেখে নিলো। আমি আর তমাল ওর দু›’হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেললাম। আর শিপন মাছগুলো রাস্তায় রেখে মেছোভূতকে ইচ্ছেমত বানাতে লাগলো। এবার মেছোভূতের জান চলে যাওয়ার অবস্থা। সে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আর কখনো একাজ করবোনা।’ ‘তোকে ছাড়ছি, তোর পেট থেকে সব মাছ বের করে নেই।’ শিপন ইচ্ছেমতো কিল, চড়, ঘুষি, লাথি মারতে লাগলো।
আমাদের এই হট্টগোল শুনে গাছ থেকে কোন ফাঁকে যে নেমে গেছোভূতটা পালিয়েছে, আমরা তা টের পাইনি। আমরা মেছো ভূতটাকে রশি দিয়ে বেঁধে পেটাতে পেটাতে হাটের দিকে নিয়ে গেলাম। তখনও হাটে অনেক লোকজন ছিলো। তারা আমাদের দেখে এবং মেছোভূতের পরিচয় পেয়ে গণপিটুনি দেয়া শুরু করলো। হাটের জনৈক লোকের কাছে জানা গেলো এই দুই ভূত আর কেউ নয় হাটের পাশের শিকদার বাড়ির বখাটে স্বপন ও সজিব। আমাদের গ্রামের মাতব্বর আসিফ চাচা হাটেই ছিলেন। তিনি ছুটে এসে সব শুনে সবাইকে থামালেন। লোকজনকে বোঝালেন এ ছেলে মরে গেলে সবাই পুলিশি ঝামেলায় পড়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো আগামীকাল গ্রাম্য সালিশে ওদের দু’জনের বিচার হবে। আর এরকম মেছোভূতকে ধরার জন্য আমাদের দলকে পুরস্কৃত করা হবে।
অনেকদিন হল আমি মাধ্যমিক পাস করার পর গ্রাম থেকে শহরে চলে আসলাম, ঐ ঘটনার পর আর কোনোদিন কারো কাছে গেছোভূত ও মেছোভূতের মাছ চুরির গল্প শুনিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন