শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সোনালি আসর

ঝুমুর কান্না

গল্প

| প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

না সি মা সু ল তা না শ ফি : পাখিরাই এখন ঝুমুর খেলার সাথী। পাখিদের সাথে খেলতে খেলতে সে তাদের ভাষাও যেন বুঝে গেছে। পাখিরা কখন কি চায়, কি পেলে খুশি হয়, কেন অভিমান করে এ সবই ঝুমু এখন বুঝতে পারে। চড়ুইগুলো যে এখন ওর সঙ্গে দুষ্টুমি করছে এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। আর তাইতো ঝুমু নিজেও ওদের সাথে দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে। চড়ুইগুলো কিচিরমিচির করে উড়ে এসে বারান্দার গ্রিলে বসে আর ঝুমু অমনি রুম থেকে বেরিয়ে এসে ওদের তাড়া করে। ঝুমুর তাড়া খেয়ে পাখিগুলো একটু দূরে কাঁঠাল গাছে গিয়ে বসে। ঝুমু বারান্দা থেকে রুমে ফিরে গেলে চড়ুইগুলো কিচিরমিচির করতে করতে আবার বারান্দার গ্রিলে এসে বসে। চড়ুইগুলো যেন কিচিরমিচির করে বলে, এই ঝুমু তুমি কোথায়, আমরা আবার এসছি। ঝুমুর সাথে চড়ুইগুলো যেন এভাবেই লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠে।
ঝুমু প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই জামাকাপড় ছেড়ে সোজা বারান্দায় চলে আসে। বারান্দায় একটা দোলনা আছে। ঝুমু দোলনায় বসে দোল খেতে খুব জমা পায়। এই দোলনায় বসে পাখিদের সাথে খেলা করে। ঝুমু পাখিদের খেতে দেয়। বারান্দার এক প্রান্তে প্রতিদিন সে কিছু ভাত না হয় চাল ছিটিয়ে দেয়। চড়ুই ময়না এবং কয়েকটা কাক এসে ভাত খায়। বারান্দার কোণে একটা ছোট্ট মাটির হাড়িতে পানি রেখে দেয়। পাখিরা ঠোঁট ডুবিয়ে কি সুন্দর পানি পান করে। ঝুমু এসব দেখে খুবই আনন্দ পায়। ঝুমুকে ওরা ভয় পায় না। ওর প্রায় কাছাকাছি এসে বসে খাবার খেতে থাকে। ঝুমুর অনেক সময় ইচ্ছে করে পাখিদের একটু ছুঁয়ে দিতে আদর করতে। তবে হাত বাড়ালেই ওরা উড়ে যায়, একটু দূরে গিয়ে বসে।
আজ চড়ুই পাখিগুলো যেন একটু বেশি চঞ্চল। কিচির মিচির করে বার বার বারান্দার গ্রিলে এসে বসছে, আবার কিচিরমিচির করে ওড়ে যাচ্ছে। ঝুমু ভাবে চড়ুইগুলো হঠাৎ এমন করছে কেন? দোলনায় বসে সে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। কালো মেঘের দল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ মেঘের গর্জন শুনতে পায় ঝুমু। তাহলে কি ঝড়বৃষ্টি আসবে? পাখিগুলো কি এজন্য এমন অস্থির হয়ে উড়াউড়ি করছে? ঝুমুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঝড় বৃষ্টি এলে পাখিগুলো কোথায় যাবে? আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগেই যেন সন্ধ্যা নেমে গেছে। টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। চড়ুইগুলো কিচির মিচির করে উড়ে গিয়ে কাঁঠাল গাছের পাতার আড়ালে দিয়ে বসছে। ঝুমুর মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। আজ আর পাখিদের সাথে খেলা হলো না। একটু পরেতো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তখন পাখিরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবে। প্রতিদিনতো বিকেলে পাখিগুলো তার সাখে খেলা করে। পাখিদের গান শুনে। আজ আর সেটা হলো না। ঝুমু দোলনা ছেড়ে রুমে যায়। ওর মন খারাপ দেখে মা বলেন, মন খারাপ করোনা সোনামণি। পাখিরাতো ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও নিজেদের বাঁচাতে জানে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রুমে বসে ঝুমু জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখে। হঠাৎ একটা কাক এসে বারান্দার গ্রিলে বসে। ঝুমুর দিকে তাকিয়ে কাকটা কা কা করে যেন কিছু বলছে। পাখা ঝাপটা দিয়ে কাকটা কা কা করে যেন বলছে, আজ আমাকে এখানে থাকতে দেবে? কাকের কথা বুঝতে পরে ঝুমু নিজের মনেই হেসে ফেলে। কাকটা এবার বারান্দায় ছড়ানো ভাত দেখে নেমে পড়ে। ঠোকর দিয়ে দু’একটা ভাত ঠোঁটে তুলে নেয়। বাইরে তখন বেশ জোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে।
পরদিন বিকেলে বারান্দায় বসে একটি নতুন পাখি দেখে ঝুমু। এমন লেজ লম্বা পাখিতো এর আগে সে দেখেনি। এ পাখিটার নাম কি? মাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন এটা ফিঙে পাখি। আজ বারান্দায় নতুন পাখি ফিঙে, দুটো শালিক আর দুটো ময়না। ইদানীং বারান্দায় খাবার খেতে অন্য পাখিগুলো আসলেই শালিক দুটো ঝগড়া করে। ফিঙেটা নতুন এসেই সব পাখিদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। সবার সাথে ঝগড়া করছে। ও যেন একাই সব দখল করতে চায়। তবে শালিক এবং ময়না ওরাও ছেড়ে যায় না। ঝুমু সব পাখিদের ভালোবাসে। পাখিদের জটলার মধ্যে হঠাৎ একটা কাক এসে বসে। কাকটা চুপচাপ ঝুমুর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক বার সে চোখের ইশারায় ঝুমুকে কিছু বোঝাতে চায়। ঝুমু কিছুই বুঝতে পারে না। কাকটাকে দেখে ঝুমুর খুব মায়া হয়। কেমন চুপচাপ বসে আছে। ওর মনে হয়তো অনেক দুঃখ। কিন্তু বলতে পারছে না। কাকদের কেউ পছন্দ করে না। কাক দেখলেই মানুষ তাড়িয়ে দেয়। ঝুমু তা করবে না। কাকটা দেখে তার খুব মায়া হয়।
ঝুমু বারান্দায় বসে চিকেন ফ্রাই খেতে খেতে পাখিদের ভাত খাওয়া দেখছিল। সব পাখি ভাত খেলেও কাকটা কিছুতেই ভাত খাচ্ছে না। ঝুমু কাকটাকে ইশারা করে ভাত খেলে বললেই কাকটা বার বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুমু বুঝতে পারে কাকটা তার সাথে অভিমান করেছে। সে তার হাতে থাকা চিকেন ফ্রাইয়ের হাড়টা কাকটার দিকে ছুড়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কাকা ছোঁ মেরে তা নিয়ে নেয়। এর পর কাঁঠাল গাছটার ডালে বসে তা মজা করে খায়। ঝুমু এবার কাকের অভিমানের ারণটা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে এ কাকটা ভাত পছন্দ করে না। ভাত দিলেই সে অভিমানে কা কা করতে থাকে। ঝুমু এর পর থেকে কাকটাকে হাড্ডি খেতে দেয়।
বেশ কয়েকদিন কাকটার কোন দেখা নেই। ঝুমু ভাবে কি হয়েছে, কোথায় গেল কাকটা। মা বলেন, ওরা পাখি। উড়ে উড়ে কত জায়গা ঘুরে বেড়ায়। পাখিরাতো এমনই। ঝুমু মনে মনে ভাবে কাকটা আবার ফিরে আসবে। সত্যি সত্যি, হঠাৎ দেখে কাকটা উড়ে এসে গ্রীলে বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ঝুমু একটু এগিয়ে গেল আর অমনি দেখলো আরও একটি কাক এসে বসলো। এ কাকটা দেখে অন্য কাকটা বেশ খুশি হয়ে উঠলো। ঝুমু এবার দুটো কাকের জন্য দুটো হাড় ছুড়ে দিল। খুশিতে কা কা করে হাড় দুটি নিয়ে কাঁঠাল গাছের ডালে গিয়ে বসলো। ফিঙে পাখিটা কাক দুটোকে সহ্য করতে পারছে না। শালিক দুটোও কি ভাবে কাক দুটোকে তাড়াবে এজন্য ফিঙের সাথে জড় হয়। পাখিদের এমন ঝগড়া দেখে ঝুমু মনে মনে হাসে। ঝুমুর দিকে তাকিয়ে এবার ফিঙে পাখিটা একেবারে চুপ হয়ে দূরে বসে থাকে। ফিঙে যেন ঝুমুর মনের কথা বুঝতে পেরে এমন চুপ হয়ে যায়। দূরে বসে মনে মনে ভাবে, শালিকের কথায় কি প্রয়োজন এমন ঝগড়া করার। সুখেইতো আছে সবাই মিলে মিশে। এভাবে ঝগড়া করে নিজের পায়ে কুড়াল মারার কোন দরকার নেই। ফিঙে পাখিটা হঠাৎই ভাল হয়ে যায়।
কাক দুটো এবার কাঁঠাল গাছের ডালে বাসা বানায়। ঝুমু দেখে ঠোচে করে খড়খুটো এনে দুটো কাক কত যতেœ তাদের বাস বানায়। ঝুমু প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে বারান্দার দোলনায় বসে কাকের বাসা তৈরীর দৃশ্য দেখে। এর পর মা কাকটা বাসায় ডিম পারে। বাসায় বসে ডিমে তা দেয়। একদিন দেখে একটা কোকিল কাকের বাসা বসে আছে। ঝুমু তা দেখে অবাক হয়ে মাকে ডেকে আনে। মা তা দেখে ঝুমুকে বলেন, সব পাখি নিজেরাই বাসা বানাতে পারে কিন্তু কোকিল নিজে বাসা বানাতে পারে না। কোকিল কাকের বাসায় ডিম পারে। কাক নিজের ডিম মনে করে তাতে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। এরপর কাকের বাসায় বড় হয়ে কোকিল একদিন উড়ে চলে যায়। বিষয়টি জেনে ঝুমু অবাক হয়। সবাই বলে কাক নাকি খুব চালাক পাখি। আসলে তো কাক খুব বোকা পাখি। কাকের বাসার দিকে তাকিয়ে ঝুমু মনে মনে হাসে।
কাকের বাসায় এবার বাচ্চা ফোটেছে। বারান্দায় বসে ঝুমু বাচ্চাদের ছিঁ ছিঁ ডাক শুনে। ক্ষুধা ফেলে বাচ্চাগুলো গলা উঁচু করে ছিঁ ছিঁ অর্থাৎ তাদের ভাষায় মা মা বলে ডাকে। কাক দুটো তখন ঠোঁটে করে বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। এ দৃশ্য দেখে ঝুমুর মন খুশিতে ভরে যায়। কাক দুটোকে এখন ঝুমু আরও বেশি করে হাড় গোস্ত দেয়।
একদিন স্কুল থেকে এসে বারান্দায় গিয়ে ঝুমুতো হতবাক। একি দেখছে সে? কাকের বাসাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। পাশে ছোট ছোট তিন চারটে মৃত ছানা এবং একটু দূরে একটা কাক মরে পড়ে আছে। সাথী কাকটা বাচ্চা এবং মৃত কাকটার চারপাশে উড়ছে আর কা কা করে বুক ফাটা আর্তচিৎকার করছে। কাকটার আর্তচিৎকারে আশপাশের সকল কাক এসে জড় হয়েছে। সবাই মিলে চিৎকার করছে। গুটা এলাকায় কা কা চিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে। সবাই মিলে যেন এই নিষ্ঠুর হত্যাকাÐের প্রতিবাদ করছে। ঝুমুর দু’চোখ জিজে যায়। মা এসে ঝুমুর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, দুটো দুষ্টু ছেলে কাকের বাসা ভেঙেছে। বাচ্চাগুলো এবং ওই কাকটাকে মেরেছে। ঝুমু কোন কথা বলে না। ওর দু’গাল বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে। কাকটা উড়ে এসে এবার বারান্দার গ্রীলে বসে। ঝুমুর দিকে তাকিয়ে বুক ফাটা আর্তচিৎকারে কা কা করতে থাকে। কাকটা যেন ঝুমুকে বলে, মানুষ কত নিষ্ঠুর, কত হিং¯্র হয় দেখ। কি দোষ করেছিল ওরা? কাকটার কথা বুঝতে পেরে ঝুমু এবার ওর মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন