রুমা দাস কেয়া
অনেক দিন আগে ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, ‘নারীর একটা নিজস্ব ঘর দরকার’ ছোট্ট একটা লাইন কিন্তু এর গভীরতা বিস্তৃত। বেগম রোকেয়া যেমন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী যোগার করেছেন, ঠিক তেমন করে নারীদের আলোর মিছিলে সামিল করতে অনেক অনেক মহীয়সী নারী পর্দার অন্তরালে নিঃশব্দে কাজ করে গেছেন। আজকের এই বৈশ্বিক শিল্পায়নের যুগে নারীর পর্দাপণ ঘটেছে সবস্থানে। যিনি হয়তো সভা-সেমিনারে যাননি কখনও কিন্তু তার গৃহে, কর্মক্ষেত্রে সমান দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদন করছেন এবং নীরবে-নিভৃতে একটি সামাজিক বিপ্লবেরও অংশ হয়ে থাকছেন।
আজকের বিশাল কর্মবাজারে ব্যাংকিং অন্যতম একটি মাধ্যম, যেখানে অসংখ্য নারীকর্মী রয়েছেন। তাদের নিজস্ব যোগ্যতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরকে। মূলত উপমহাদেশে ব্যাংকিংয়ের সূচনা ঘটে আফগান ব্যবসায়ীদের হাত ধরে, যারা আমাদের কাছে কাবুলীওয়ালা বলে পরিচিত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংকিং প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ব্যাংকিং শুরু হয় ১৯৭২-এ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর যাত্রার মাধ্যমে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে রয়েছে অসংখ্য ব্যাংক। যেখানে নারীর জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র যোগ হয়েছে এবং সাথে সাথে হয়েছে নারীর না বলা অসমাধানযোগ্য সমস্যারও।
কেস স্টাডি ১
ছদ্দনাম- আলেয়া হোসেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা : মাস্টার্স
বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত
সন্তান- ২ জন
বয়স- ৩৩ বছর
আলেয়া একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। তার স্বামীও একটি বেসরকারী ফার্মে কর্মরত। আলেয়া অফিসে যোগদানের পর থেকেই শুনে আসছেন ‘মেয়েরা কেন যে এই সব পেশায় আসে, করবে শিক্ষকতা’, পুরুষ সহকর্মীদের ধারণা, ব্যাংকে সময় বেশি দিতে হয়, মহিলা কর্মীরা বাসায় যেতে ব্যস্ত তাই এই চাকরী তাদের জন্য নয়।
কেস স্টাডি-২
ফাজানা আক্তার, মাস্টার্স
বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত
সন্তান- ১ কন্যা
ফারজানা চাকরিতে যোগদানের পর মাতৃকালীন ছুটিতে যান, পুরুষ সহকর্মীদের মন্তব্য মেয়েদের তো বারমাস ছুটি’কি সৌভাগ্য এবং ছুটি থেকে ফিরবার পর রীতিমত যুদ্ধ করে নিজের স্থান পুনুরুদ্ধার করতে হয়েছে তাকে।
কেস স্টাডি-৩
রোমানা আফরোজ
সরকারি ব্যাংকে কর্মরত
সন্তান- ১ জন
রোমানার দিন শুরু হয়, দিন শেষ হয় সন্তানের চিন্তায়। রোমানর শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়িতে কাছের কেউ নেই ওর সন্তানকে দেখার। ১ মাত্র সন্তান থাকে গৃহকর্মীর কাছে। স্বাভাবিকভাবেই তার অফিস থেকে বাসায় ফিরবার তাড়া থাকে, এতেই সহকর্মীদের টীকা টিপ্পনী।
কেস স্টাডি- ৪
দিলশাদ বেগম, মাস্টার্স
সরকারি ব্যাংকে কর্মরত
সন্তান-১ জন
দিলশাদ অফিস করে ঢাকাতে আর সন্তানকে রেখে আসতে হয়েছে শ্রীপুর মাওনায়। প্রতিদিন রাত ১১টায় মাওনা গিয়ে পৌঁছে। ছোট্ট বাচ্চা রেখে রাতে থাকতেও পারে না। দিলশাদের ভাষায় ‘মেয়ে হচ্ছে মায়ের সারা জীবনের দায়’ কারণ আমার মা যেমন আমাকে মানুষ করেছেন তেমনি আমার এবং আমার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমার সন্তানকেও দেখভাল করতে হচ্ছে।
কেস স্টাডি-৫
দিলরুবা আক্তার, মাস্টার্স
সন্তান-১ জন
বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।
দিলরুবা সন্তান জন্মদানের পর ১ মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে আসছেন। কারণ সন্তানকে দেখার জন্য কোন লোক পাওয়া যায়নি। দিলরুবার ভাষায় ‘বাব, মা মারা গেছে ছোট বেলায়, বুঝতে পারিনি, চাকরিটা ছাড়তে চেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে।’ এই হচ্ছে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আমাদের মহিলারা কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন যুদ্ধ করে, ঘর সামলাচ্ছেন, সন্তানকে দেখভাল করছেন, সবই করছেন সুপার লেডির মত করে।
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সনদে স্বাক্ষর করে নারীর, অর্থনৈতিক ক্ষতায়নকে বাস্তবিকরূপদান করেছে। কিন্তু এখন সময় প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে তার প্রতিকার করা। প্রথমত, মেয়েরা এখন তুলনামূলকভাবে ভালো ফলাফল করে উচ্চশিক্ষার শিক্ষিত হচ্ছেন সংখ্যাতীতভাবে। তাদের একটি বা কয়েকটি চাকরির তকমা গায়ে দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে না। তারা সব সেক্টরেই কাজ করবে।
আমাদের ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে হবে কর্মঘণ্টা এবং কর্মপরিবেশ কি ভাবে নারীর অনুকূল হবে। কারণ নারী সন্তান ধারণ এবং পালন করবে। তারাই জাতির ভবিষ্যৎ। দেশের স্বার্থে নারীর মাতৃত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার থাকাটা এখন অতি আবশ্যক, তা হলে নারী তার পূর্ণ মনোযোগ কর্মক্ষেত্রে দিতে পারবে। নারী সন্তান জন্মদান নিরুৎসাহিত হলে শিক্ষিত মা, শিক্ষিত একটা জাতি তৈরির উপাদান থেকে সমাজ দেশকে বঞ্জিত করবে ধীরে ধীরে। এখন ডিজিটালাইজ যুগে সনাতনী ধারা পাল্টাতে হবে- যেমন : ব্যাংকের চাকরি মানেই আনলিমিটেড সময় দিতে হবে। প্রত্যেকেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে কর্মক্ষেত্রে এবং পারিবারিক জীবনকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তা হলে নারীর জন্য হয়তো বন্ধুর পথটা সহজ হবে।
নীতিনির্ধারকদের মূলত এখন সময় আসছে নারীদের কথা চিন্তা করে প্রতিটি সেক্টর কর্মপরিবেশ পুনর্মূল্যায়িত এবং পুনর্বার সজ্জিত করা, কারণ সামনের দিনে মহিলারা দলে দলে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করবে এবং তাদের হাতে যেহেতু ভবিষ্যৎ : প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অতএব সেটি নিশ্চিত করতে বন্ধুর রাস্তাকে সহজ করতে হবে, যাতে কোন পিতা, মাতা নিরুৎসাহিত না হয় কন্যা সন্তানের উচ্চ শিক্ষার প্রশ্নে।
সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাহলেই দূর হবে কর্মজীবী নারীর সমস্যা ও না বলা কথা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন