হাফেজ ফজলুল হক শাহ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফ্রান্সের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রুনান (জবহধহ) স্বরচিত “ইবনে রুশদের ধর্মতত্ত্ব” গ্রন্থে লিখেছেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাস মৃত্যুর আগে একটি লিখিত দস্তাবেজ রেখে যান যা তার পরোলোক গমনের পর পঠিত হয়। এতে তিনি সাগর পরিবেষ্টিত জনবসতিপূর্ণ একটি মহাদেশ দেখার প্রতি ইঙ্গিত করেন, তার পৌঁছার আগেই যে মহাদেশটি আবিষ্কৃত হয়।
ড. আব্দুল আযীয বি-আব্দুল্লাহ তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “এক দল মুসলিম নাবিক আফ্রিকা থেকে সমুদ্র অভিযানে বের হয়ে ব্রাজিলের উপকূলে গিয়ে পৌঁছে। তারা সেখানে “আল-বাইনুকিয়া” (খধহমঁব চঁহরয়ঁব) ভাষায় লিখিত শিলালিপি দেখতে পায়। যা উত্তর আফ্রিকার ভাষার অনুরূপ ছিল।
আদি আমেরিকানদের রীতি ইসলামী ঐতিহ্যের অনরূপ
খালিদ আব্দুর রউফ একজন মার্কিন যুবক। তার পূর্ব নাম তরবী বানছর। তিনি সুইডিশ বংশোদ্ভূত। তার মা আমেরিকার প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান গোত্রের প্রসিদ্ধ কবিলা শিরকীর মেয়ে। আমেরিকায় এই শিরকী কবিলাটি ইউরোপীয় জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রসিদ্ধ। খালিদ আব্দুর রউফ তার মায়ের বংশের লোকদের ইসলামী ঐতিহ্যের অনুরূপ কৃষ্টিকালচারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, “আদি রেড ইন্ডিয়ান গোত্রের পুরুষরা মাথায় পাগড়ী বাঁধত এবং মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে মস্তক ও অবয়ব আবৃত করে চলা ফেরা করত। আমার পূর্ব পুরুষরা যদি তাদের ধর্মকে সংরক্ষণ করতে পারে তাহলে আমরা কেন আমাদের পূর্ব ধর্মের ফিরে যেতে পারব না? ইনশাআল্লাহ আমরাও যে কোন মূল্যে সেই শাশ্বত ধর্ম রক্ষা করবই।”
মাহের আব্দুর রাজ্জাক একজন মসলমান এবং নিউইয়র্কের ভারতীয় শিল্পীগোষ্ঠীর একজন সদস্য।
লেখালেখিতে ভাল হাত আছে তার। কয়েক বছর পূর্বে “মেসেজ” নামক এক ইংরেজি ম্যাগাজিনে ক্ষুদ্র একটি নিবন্ধ লিখেছেন। শিরনাম ছিল, “রেড ইন্ডিয়ানদের শিকড় অনুসন্ধান।” তার এই নিবন্ধে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলোর প্রায় ভাষা আরবী শব্দে সমৃদ্ধ। প্রত্যেক গোত্রের আভিধানে আল্লাহ শব্দ আছে। মাহের আব্দুর রউফ আরো বলেন, প্রাচীন আমেরিকান মেয়েদের প্রধান পোশাক ছিল লম্বা উড়না ও হিজাব। আর পুরুষদের পোশাক ছিল হাঁটু পর্যন্ত ঝোলান এবং পাগড়ী সদৃশ্য মস্তাকাবরণ।
তিনি লিখেছেন, ১৬০০ থেকে ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত উদ্ধারকৃত অনেক পুরনো দস্তাবেজ এ কথা বলে যে, রেড ইন্ডিয়ান গোত্রে মুসলমানদের অনেক প্রভাব ছিল। তার একটি দলিল হল, ১৭৮৭ সালে দেলোরা নদীর তীরে স্বাক্ষারিত শান্তি চুক্তি। এ সন্ধিতে রেড ইন্ডিয়ানদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন, আব্দুল হক এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ। অন্য আরেকটি দলিল হল- কংরেসের মার্কিন ফেডারেল আদালতে পেশকৃত পিটিশন। এতে এ কথার উল্লেখ ছিল যে, মার্কিন সরকার আমেরিকার মূল সংবিধান প্রণয়নের সময় রেড ইন্ডিয়ানদের সহযোগিতা নিয়েছিল। বর্তমানে এসব দস্তাবিজ আমেরিকার কংগ্রেস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রয়েছে।
কলম্বাসের শিকারোক্তি
ক্রস্টোফার কলম্বাস সর্ব প্রথম আমেরিকায় অবতরণের পর সেখানে তিনি কিছু মানুষ দেখতে পান। অনুসন্ধানে তিনি জানেন এরা এই দ্বীপের প্রাচীন বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ান গোত্রের লোক। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় তার প্রথম অভিযানের ডায়রীতে লিখেছেন, আমেরিকার অতি প্রাচীন অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা পৌত্তলিক বা প্রতীমা পূজারী ছিল না। তাদের আকিদা বা বিশ্বাস ছিল শক্তির উৎস আকাশে। তবে তারা খৃষ্টানও ছিল না। কারণ যদি তারা খৃষ্টান হত তাহলে আমার অভিযানের যে মুখ্য উদ্দেশ ছিল “খৃষ্টবাদ প্রচার করা” আমি তা তাদের কাছে উল্লেখ করতে কনোভাবেই কার্পণ্য করতাম না। বরং সৎসাহে তা উল্লেখ করতাম। সুতরাং আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, ক্রিস্টোফার কলম্বসের আভিযানের পূর্বে আমেরিকায় যে রেড ইন্ডিয়ান গোত্রে বাস ছিল তারা নিঃসন্দেহে একত্ববাদীতে পূর্ণ বিশ্বাসী মুসলমান ছিল।
মুসলিম নাবিকদের সম্ভব্য আমেরিকা অভিযানের কিছু তথ্য
প্রাচীনকালে অনেক মুসলমান নাবিক কর্তৃক বিভিন্ন সামুদ্রিক অভিযানের কথা ঐতিহাসিকভাবে উল্লিখিত রয়েছে। হয়ত হতে পারে তাদের এসব অভিযাত্রী তরীসমূহ আটলান্টিক মহাসাগরের “আল-মারাকা” (আমেরিকা) দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছেছে। ড. আব্দুল আযীয বিন-আব্দুল্লাহ লিখেছেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আগেই মুসলিম নাবিকগণ আমেরিকায় গিয়ে হাজির হন। ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ভূগোল বিশেষজ্ঞ আল্লামা আবুল হাসান আলী বিন আল হুসাইন আল-মাসউদী (৮৭১-৯৫৭খৃঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “মরুজ্জাহাব ওয়া মআদিনুল জাওহার” বইয়ে লিখেছেন, স্পেনে উমাইয়া শাসক আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ (৮৮৮-৯১২খৃঃ) এর শাসনামলে কর্ডোভা থেকে খশখাশ বিন সাঈদ বিন আল-আসওয়াদ নামক এক নাবিক ৮৮৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে আভিযানে বের হয়েছিলেন। কিছুদিন পর তিনি অজ্ঞাত এক দ্বীপ থেকে মূল্যবান মণিমুক্তা আহরণের পর স্পেনে প্রত্যাবর্তন করেন।
বিশিষ্ট ভূগোলবেত্তা শরীফ আল-ইদ্রিসী (১০৯৯-১১৬৬) তার “নুযহাতুল মশতাক ফী ইফতিরাকিল আফাক” গ্রন্থে লিখেছেন, একদা এক দল মুসলিম নাবিক উত্তর আফ্রিকা থেকে সমুদ্র অভিযানে বের হয়। তারা দশ দিন চলার পর সমুদ্র মাঝে গজে উঠা একটি দ্বীপ দেখতে পায়। এ দ্বীপে ছিল বসতবাড়ি ও ফসল ফলানো সোনার মাঠ। অভিযাত্রী দল অধিবাসী কর্তৃক হামলার আশঙ্কায় শক্তি সঞ্চয় করে জাহাজের মুখ সেদিকে ফিরিয়ে দেয়। অবশেষে মুসলিম নাবিকগণ সে দ্বীপে অবতরণ-পূর্বক দেখল সুঠাম দেহ ও সুন্দর চুলবিশিষ্ট লোকেরা সেখানে বসবাস করছে। যাদের দৈহিক আকৃতি ছিল দীর্ঘ ও মুখাবয়ব ছিল সুদর্শন ও সুগঠিত। মুসলিম নাবিকগণ তাদের বাড়িতে তিন দিন অপেক্ষা করে। চতুর্থ দিন দ্বীপবাসীদের মধ্য থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো, যে আরবী ভাষা বুঝত। স্থানীয় লোকটি তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইল, তারা কোন দেশ থেকে এসেছে। মুসলমানরা তার সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়।
মুসলিম স্পেনের কৃতী সন্তান বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে রুশদের (১১২৬-১১৯৮ খৃঃ, ৫২০-৫৯৫ হিঃ) চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর লিখিত যুগান্তকরী কিতাবের নাম “আল-কুললিয়াত”। তিনি এতে দশটি দলিল উল্লেখ করেন, যা প্রমাণ করে আরবের লোকেরা আগে থেকেই আমেরিকা সম্পর্কে অবগত ছিল। তিনি লিখেছেন, একাদশ শতব্দীর পূর্বে আরবরা মুসলিম বিশ্বের বন্দর থেকে সামুদ্রিক যাত্রা করে আমেরিকার সৈকতে গিয়ে নোঙ্গর করেন এবং তারা সেখানে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৬০ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত “নিউজ উইক” কাগজে এ তথ্যটি ছাপা হয়।
প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক শিহাবদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ বিন ফাজেল আল-ওমরী (১৩০০-১৩৮৪ খৃঃ, ৭০০-৭৮৪ হিঃ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “মাসালিকুল আবসার ফী মামলিকির আমসার”-এ মুসলমান রাজা বাদশাদের আমলে মুসলিম নাবিকগণ কর্তৃক সমুদ্র অভিযানের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন, যার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি প্রদান সংবাদ পত্রের ক্ষুদ্র কলেবরে আদৌ সম্ভব নয়।
ক্যাপ্টেন শিলিজটোন (ঝবষরলঃড়হ) ১৯৮৯ সালে লন্ডনে প্রকাশিত তার “আফ্রিকার ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন, পশ্চিম আফ্রিকার মালী শাসক মুনছী মূসা (১৩১২-১৩৩৭ খৃঃ) ১৩২০ সালে মক্কা গমনকালে কায়রোর মামলুকী খলীফা নাসিরুদ্দীন মুহাম্মাদ তাকে জানান যে, তার ভাই বাদশাহ আবু বুখারী আটলান্টিক মহাসাগরে দুটি অভিযাত্রী দল প্রেরণ করেছেন। প্রথম দলে ৪০০টি জাহাজ এবং দ্বিতীয় দলে ২০০০টি জাহাজ রয়েছে।
উপরোল্লিখিত ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর কোনটিতে যদি আমেরিকার সফর উদ্দেশ্য হয় (বর্ণনাভঙ্গি তাই বুঝাচ্ছে) তাহলে মুসলমানরাই কলম্বাস পৌঁছার পাঁচ শতাব্দী পূর্বে আমেরিকায় পৌঁছে ছিল। পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম শাশ্বত ইসলামের পর্বত প্রমাণ অবদান যে জগৎ ছুঁয়ে আছে তাঁর অতি ক্ষুদ্র ও সামান্য উপমা মুসলমানগণ কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কার করতে গিয়ে আমাদের পূর্বসূরীরা পশ্চাতে যে ইতিহাস নির্মাণ করে গেছেন তা থেকে আমাদের প্রেরণা নিয়ে দুনিয়ার প্রতিটি মানুষকে জানাতে হবে আমেরিকার আবিষ্কারক খৃষ্ট তনয় ক্রিস্টোফার কলম্বাস নন। আমেরিকার আবিষ্কারের গৌরব একমাত্র মুসলমানদের প্রাপ্য। আশা করা যায়- আমেরিকা একদিন মুসলমানদেরই হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন