চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আবারো এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হলো। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সোহেল আহমদ নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। এ সময় সংঘর্ষে আরো অন্তত ৩ জন গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা যায়। মঙ্গলবার দুপুরে সোহেলের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের সমর্থক ছাত্রলীগ কর্মীদের বিক্ষোভ, অবরোধ ও ভাঙচুরের তা-বে পুরো চট্টগ্রাম নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, সিসিসি’র সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দিন সমর্থিত ছাত্রলীগের সংঘাতে সোহেলের মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে উভয় গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে প্রিমিয়ার ভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করেছে। দেশে এখন সরকারবিরোধী কোনো কার্যকর আন্দোলন নেই। রাজনীতিতেও তেমন উত্তাপ নেই। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও চলছে সরকারি দলের আধিপত্যে একতরফা। তারপরও থেমে নেই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেক স্থানেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের অনুপস্থিতিতে সরকারি দলের এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটছে।
গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক মেধাবী শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যুর খবর দেশের বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অটোরিকশাচালক বাবার একমাত্র পুত্রসন্তান হাফিজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগের ‘বড়ভাই’রা তাকে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের বারান্দায় থাকতে দেয়ার বিনিময়ে তীব্র শীতে রাত জেগে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় হাফিজুর। অসুস্থ হাফিজুরকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে সেখানে সে বিনা চিকিৎসায় করুণ মৃত্যুর শিকার হয়। এভাবেই ছাত্রলীগের অপরাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি হয় হাফিজুরের মতো সম্ভাবনাময় তরুণ। এরই সাথে চিরতরে অমানিশায় হারিয়ে যায় একেকটি পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য এবং জীবনের সোনালি স্বপ্ন। গতকালও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র শিক্ষার্থী সোহেল আহমেদের বাবার বুকফাটা কান্না ও আহাজারির হৃদয়বিদারক দৃশ্যের ছবি। শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় ছাত্রলীগের অব্যাহত সন্ত্রাস আত্মঘাতী রূপ নিয়েছে আরো কয়েক বছর আগেই। একসময় প্রধানমন্ত্রীও রাগ করে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের এক ছাত্র সমাবেশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা শেখ হাসিনার কাছে আর ভুল না করার ওয়াদা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির দেড় মাসের মাথায় একটি মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়Ñ‘নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রতিজ্ঞা ভেস্তে গেল।... গুলির লড়াই, কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ছাত্রলীগকে।’ একসময়কার ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির কর্মীরা এখন জড়িয়ে পড়েছে খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, শিক্ষক ও ছাত্রী লাঞ্ছনার মতো ঘটনায়। ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ শাসনামলের প্রথম ৬ বছরে ছাত্রলীগের দ্বারা সংঘটিত সাড়ে চার শতাধিক সংঘাতে অন্তত ৫৪ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৯ জনই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার। হালনাগাদ হিসাবে এ সংখ্যা নিশ্চয়ই আরো অনেক বাড়বে।
দেশে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় এক অস্থির অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে পড়েছে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক শিশুহত্যা থেকে শুরু করে সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত স্থানে কলেজছাত্রী ধর্ষিত ও নিহত হওয়ার ঘটনায় একটি কুৎসিত সামাজিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলার চিত্রই বেরিয়ে আসে। আর এই বিশৃঙ্খলার জন্য আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং রাজনৈতিক কারণে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন নাগরিক সমাজ ও বিশ্লেষকরা। ছাত্রলীগের সাথে প্রতিপক্ষের প্রায় প্রতিটি সংঘাত অথবা আভ্যন্তরীণ কোন্দলের সময় পুলিশকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এমনকি হত্যাকা- ও ছাত্রী লাঞ্ছনার মতো ঘটনায় জড়িতদের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পুলিশের হাতে থাকার পরও প্রকৃত দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের হাতে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতার গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা নিহত হওয়ার একাধিক ঘটনাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে গেছে। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা নেতারা স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার এবং মাঠ দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ায় সর্বত্র রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা বেড়ে গেছে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণ বা বিদায় অনুষ্ঠানেও এর প্রভাব পড়ছে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সোহেল আহমেদ তার সর্বশেষ শিকার। এসব সংঘাত ও হত্যাকা- আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিনষ্ট করছে। প্রতিটি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দলনিরপেক্ষ ও পেশাদার ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন