রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ছত্রাকবাহী ব্লাস্টে গম আবাদে দেশ পিছিয়ে পড়ল লক্ষ্যমাত্রা হৃাসের পরেও তা অর্জিত হয়নি

| প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : পর পর দু বছর চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে দেশে সম্ভাবনাময় দানাদার খাদ্য ফসল গম-এর আবাদ এবার যথেষ্ঠ হোচট খেল। শীত প্রধান দেশের এ দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদনে ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হলেও বিগত দুটি বছর দেশের দক্ষিন ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ রোগের সংক্রমনের ফলে ইতোমধ্যে কৃষকগন ঐ ফসল আবাদ ও উৎপাদনে কিছুটা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সরকারও ব্লাষ্ট আক্রান্ত জেলাগুলোতে গতবছর ও চলতি রবি মওশুমে কোন বীজ সরবরাহ না করার পাশাপাশি গম আবাদকে নিরুৎসাহিত করেছে। গত দুটি বছর বরিশাল অঞ্চলের ভোলা ছাড়াও যশোর কুষ্টিয়া অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ছত্রাকবাহী বøাষ্ট রোগের সংক্রমনে গমের উৎপাদনে ধস নামে।
ফলে চলতি রবি মওশুমে সারা দেশে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ৪লাখ ১০ হাজার হেক্টরে হৃাস করে উৎপাদন লক্ষ্যও ১৩.৭০লাখ টনে হৃাস করা হয়। তবে সে লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হয়নি। অথচ তিন বছর অগেও প্রায় পৌনে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন গম উৎপাদিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬-এর শুরুতে পূর্ণ মওশুমে দেশের ৫টি জেলায় গমের জমিতে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ রোগের সংক্রমন শুরু হয়। এ রোগের কোন প্রতিষেধক নেই। ফলে আক্রান্ত জমির গম অতি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি ২০১৬ তে কিছু জমির গম ক্ষেত আগুনে পুড়িয়েও ফেলতে হয়েছে। তবে কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, ‘যেসব এলাকায় ব্লাষ্ট-এর সংক্রমন ঘটে থাকে, সেসব এলাকায় পর পর অন্তত দুটি বছর আবাদ বন্ধ রাখলে পরবর্তীতে ছত্রাকবাহী ঐ রোগের প্রকপ দেখা দেয়না। কিন্তু ২০১৬সালে আক্রান্ত এলাকাগুলোতেও গত বছর কিছু জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। গতবছরই প্রথমবারের মত গম পেরিয়ে ব্লাষ্ট-এর সংক্রমন ইরি-বোরো ধানেও সমপ্রসারন ঘটে।
এসব নানা কারনেই চলতি বছর গম আবাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি দেশে। গম আবাদের সময় পেরিয়ে এখন উৎপাদনের পর্যায়ে। ডিএই থেকে প্রাপ্ত হিসেবে দেখা গেছে, চলতি রবি মওশুমে দেশে গম আবাদের লক্ষ্য সীমিত করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেশের মাত্র ৩ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। ফলে প্রায় পৌনে ১৪ লাখ টন গম উৎপাদনের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল, তা অর্জন নিয়ে কিছুটা হতাশ কৃষিবিদগন।
অথচ দেশের তৃতীয় বৃহত্তম এ দানাদার খাদ্য ফসল আবাদ অত্যন্ত সহজ। জমি তৈরী থেকে শুরু করে সেচ, সার, বালাই ব্যবস্থাপনা সহ পরিচর্যা ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কম। গমের দামও ধানের চেয়ে বেশী। এসব কারনে বিগত কয়েকটি বছর গম কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তা ইতোমধ্যে যথেষ্ঠ হোচট খেয়েছে। যা আমাদের কৃষক ও কৃষি-অর্থনীতির ওপরও যথেষ্ঠ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এমনকি চলতি মওশুমে শীত কিছুটা আগেভাগে বিদায় নেয়ার কারনেও গমের উৎপাদন কিছুটা হলেও ব্যাহত হবার আশংকা রয়েছে বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। শীত প্রধান দেশের এ খাদ্য ফসল তাপমাত্রার সাথে সংগতিপূর্ণ। তাপমাত্রার পারদ যত নিচে নামবে এবং তা স্থায়ী হবে, গমের উৎপাদনও তত বাড়বে। তবে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগন ‘শতাব্দী’ সহ বেশ কয়েকটি তাপ সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল জাতের গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন। যা অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায়ও ভাল ফলন দিয়ে থাকে। কিন্তু এখনো উন্নতমানের এ তাপ সহিষ্ণু গম বীজ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌছান নিশ্চিত করা যায়নি।
তবে কৃষি সমপ্রসারন অধিদফ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, চলতি মওশুমে বøাষ্ট রোগের সংক্রমন না ঘটলে আগামী মওশুম থেকে গম নিয়ে কৃষকরা আবার ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হবে। ডিএই বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দেখছে বলেও জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
আমাদের দেশে খাদ্য ফসল হিসেবে গম ইতোমধ্যেই তৃতীয় শীর্ষস্থান দখল করেছে। পাশাপাশি নিকট অতীতে সারা বিশ্বে গম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম পর্যায়ে থাকলেও বিগত দুটি মওশুমের বিপর্যয়ের কারনে তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি । তবে আমাদের দেশে গম আবাদ ও উৎপাদনের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। সত্ত¡রের দশকে দেশে মাত্র ১লাখ হেক্টর জমিতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত ‘খেরী, আইপি-৫২ ও আইপি-১২৫’ জাতের গম বীজ-এর আবাদ হত। উৎপাদন পরিস্থিতি অনুকুল ও কৃষকের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বিদেশ থেকে ‘কল্যাণ সোনা’ ও ‘সোনালিকা’ জাতের মধ্যম মানের উচ্চ ফলনশীল গমবীজ আমদানী করে এর আবাদ সমপ্রসারন কার্যক্রম শুরু করা হয়। স্থানীয়জাতের তুলনায় এসব গমের উৎপাদন প্রায় ৩গুন বেশী হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহেরও সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে গমের আবাদ ও উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৫সালে আমাদের দেশে প্রায় ৫লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে প্রায় ১২লাখ টন গম উৎপাদন সম্ভব হয়।
এরপরে আমাদের কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট একাধিক জাতের উচ্চ ফলনশীল গম-এর জাত উদ্ভাবন করেছে। এমনকি আমাদের দেশের মত কম শীত প্রধান অঞ্চলের জন্য ‘শতাব্দী’ নামের গম বীজও উদ্ভাবন করেছে ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’এর বিজ্ঞানীগন। বারি উদ্ভাবিত গম বীজের মধ্যে ‘কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী , শতাব্দী ছাড়াও সৌরভ-বারি-১৯, ও গৌরব-বারি-২০’ নামেরও উচ্চ ফলনশীল বীজ সহ আরো একাধিক গম বীজও রয়েছে। অতি সমপ্রতি ‘ব্লাষ্ট’ প্রতিরোধী গম বীজ উদ্ভাবনেও অগ্রগতি অর্জন করেছে বারি। এসব বীজ থেকে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৩টন থেকে সাড়ে ৪টন পর্যন্ত গম উৎপাদন সম্ভব বলে বারি’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতেও গম আবাদের অপার সুযোগ থাকলেও সে লক্ষ্যে নিবিড় কোন কার্যক্রম এখনো গ্রহন করা হচ্ছেনা কৃষি সমপ্রসারন অধিদফতর থেকে। ইতোপূর্বে সারা দেশে গম আবাদ যেভাবে দ্রুত সমপ্রসারন ঘটেছে, দক্ষিণাঞ্চলে তার প্রতিফলন ঘটেনি। অথচ কম সেচ ও রোগবালাইয়ের ঝুঁকি সহনশীল থাকায় দক্ষিণাঞ্চলে গমের আবাদ আরো দ্রুত সমপ্রসারনের সুযোগ ছিল বলে মনে করছেন কৃষিবিদগন। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের চর সহ কম সেচ সুবিধার উচু দোঁআশ মাটিতে গম আবাদের অপর সুযোগ থাকলেও এক্ষেত্রে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছেনা। এমনকি গমের চাষাবাদ পদ্ধতিও অনেক সহজ এবং মাত্র ১০৩-১১০দিনে ফসল ঘরে তোলা যায়।
হেক্টরপ্রতি ১২০কেজি বীজ এবং ১৮০কেজি ইউরিয়া, ১৪০-১৮০কেজি টিএসপি, ৪০-৪৫কেজি এমপি, ১১০-১২০কেজি জিপসাম ও যতটা সম্ভব বেশী গোবর সার প্রয়োগ করলে সাড়ে ৩টন থেকে ৪টন পর্যন্ত গম উৎপাদন করা সম্ভব। কৃষিবিদদের মতে, অধিক আর্দ্রতাযুক্ত জমিতে বিনা সেচে গম আবাদ করতে পারলে রাসয়নিক সারের পরিমান আরো কিছুটা কম লাগবে। বিগত কয়েকটি বছর গমের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা যথেষ্ঠ লাভবান হচ্ছেন। তবে এখনো দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ গম আবাদ হচ্ছে ফরিদপুর, ভোলা, রাজবাড়ী শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলাগুলোতে। বরিশাল জেলাতেও গমের আবাদ ধীরে স¤প্রসারনশীল হলেও বিগত দুটি বছর বøাষ্ট-এর সংক্রমনের কারনে তা যথেষ্ঠ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বারি উদ্ভাবিত শতাব্দী জাতের গম বীজ সহ তাপ সহনশীল অন্যান্য বীজ এবং এর আবাদ ও উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে পৌছে দিতে পারলে দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ১লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে ৪লাখ টন গম উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন কৃষিবিদগন। এক্ষেত্রে কৃষি স¤প্রসারন অধিদফতর, বারি ও বিএডিসি’র বীজ উইংকে মাঠ পর্যায়ে পারস্পারিক নিবিড় যোগাযোগ সহ সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা বা¯তবায়নের তাগিদে দিয়েছেন কৃষিবিদগন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন