৭ মার্চ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে যোগ দিতে আসার সময় বেশ কয়েকটি স্থানে দলটির কর্মীদের দ্বারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজন লাঞ্চিত ও শ্লীলতাহানির শিকার হন। রাজধানীর বাংলামোটর, শহীদ মিনার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, খামারবাড়ি, কাকরাইল ও কলাবাগানে এসব ঘটনা ঘটে। ঘটনার শিকার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ফেসবুকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে স্ট্যাটাস দেন। মুহূর্তে এসব ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় হয়। লোকজন ক্ষোভ, ঘৃণা ও ধিক্কার জানাতে শুরু করে। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে। লাঞ্চিত হওয়ার এ ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সমাবেশের বাইরের ঘটনার দায় দলের নয়। এ দায় সরকারের। তার এ বক্তব্য নিয়েও সর্বত্র সমালোচনা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলামোটরে ঘটা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। ফুটেজ দেখে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি তারা অভিযোগ না করে তবে আমরা আইনি সহায়তা কীভাবে দেব? তারপরও মানবিক দিক বিবেচনায় আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি।
৭ মার্চের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের মিছিল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী এবং অন্য নারীদের যৌন হয়রানি এবং লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। বিশেষ করে এমন এক ঐতিহাসিক দিনে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত এহেন অসভ্য আচরণ দিবসটির ভাবমর্যাদাই বিনষ্ট করে দিয়েছে। এ ধরনের অশোভনীয় ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের জনসভার দিন ঘর থেকে বের হতে নারীরা যে ভীত-শঙ্কিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ঘটনায় দলের দায় নেই বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঐদিন তার দলেরই সমাবেশ ছিল এবং দলের লোকদের মিছিল থেকেই এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, এর দায় দলের ওপরই বর্তায়। সরকারের দায় বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাছাড়া দলই তো সরকার পরিচালনা করছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা এ ধরনের ঘটনা ঘটানো নতুন কিছু নয়। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন ছিল, তখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগেরই এক নেতার ধর্ষণে সেঞ্চুরী এবং তা উদযাপনের কথা ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। বছর কয়েক আগে পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে ক্ষমতাসীন দলেরই কর্মীদের দ্বারা নারী লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। এছাড়া সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা যৌন হয়রানি এমনকি ধর্ষণের ভিডিও ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে পুলিশকে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে বেপরোয়া ও আক্রমণাত্বক আচরণ করতে দেখা যায়। মিছিল-সমাবেশ থেকে তান্ডব সৃষ্টি করে অমানবিকভাবে টেনেহিঁচড়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা গুরুতর অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশকে নীরব হয়ে যেতে দেখা যায়। তদন্ত চলছে, ব্যবস্থা নেব-এসব মৌখিক বক্তব্যের মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে একসময় তা ধামাচাপা দেয়া হয়। ক্ষমতার দাপটের কাছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সব অপরাধই তুচ্ছ হয়ে পড়ে। প্রশ্রয় পেয়ে তারা দুর্বীনিত হয়ে উঠছে। রাস্তা-ঘাটে নারীদের শ্লীলতাহানি ও লাঞ্চিত করা তাদের কাছে আনন্দ ও উল্লাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এ ধরনের বিকৃত মানসিকতারই শিকার হয়েছে ৭ মার্চ বিভিন্ন শ্রেণীর নারী।
ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ভীতি ও আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। অথচ হওয়ার কথা উল্টা। মানুষকে আশ্বস্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করা তাদের দায়িত্ব। দেখা যাচ্ছে, তারা রক্ষক না হয়ে ভক্ষকের আচরণ করছে। ৭ মার্চের ঘটনা নতুন করে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে সামনে যে নির্বাচন রয়েছে, তার বিভিন্ন কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস পাবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে সম্ভ্রম ও আব্রæ হারানোর আশঙ্কা তাদের মধ্যে কাজ করবে। এমনিতেই ঘরে-বাইরে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান। অপহরণ, খুন, গুমের পাশাপাশি এখন দেখা যাচ্ছে, সম্মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তাও উধাও হয়ে গেছে। যেখানে সেখানে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির যদি উত্তরণ ঘটানো না যায়, তবে সামনে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ৭ মার্চ যেসব স্থানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে তার একটির ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, বাকি যেসব স্থানে সিসি ক্যামেরা রয়েছে সেগুলোরও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাদের মুখোশ জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। শুধু ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বক্তব্য দিয়ে দায় এড়ানো কিংবা তদন্ত করা হচ্ছে বলে সময়ক্ষেপনের মাধ্যমে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন