ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে বিগত দিনগুলোতে দু’দেশের কেউই তেমন উদ্যোগ নেয়নি। তবে এ দু’দেশের মধ্যে সমস্যা রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গা যাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সকল পক্ষ। ইতোমধ্যেই অনেক জল গড়ানোর পর নভেম্বর ২০১৭ সালের মাঝামাঝি ওই বছরের আগস্ট হতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয় বাংলাদেশ-মিয়ানমার এক ধরনের স্মারক তৈরি করেছে। এ ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশ চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক না বললেও সাধারণের কাছে এক ধরনের চুক্তিই মনে হবে। এ ব্যবস্থাপনার আওতায় দুই মাসের মধ্যে কিছু একটা হওয়ার কথা হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তেমনভাবে হয়নি। তবে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির আওতায় ৪ শত হিন্দু ধর্মালম্বী রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মিয়ানমার সরকার। এর মাধ্যমে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বীজ বেশ গভীরভাবে বপণ করল। প্রমাণিত হলো যে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিদ্বেষ শুধুমাত্র একটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য মুসলমানদেরও বিরুদ্ধে।
রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে বিশ্ব প্রায় দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। এর কারণ মিয়ানমারের ভূ-কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে এশিয়ার সুপারপাওয়ার চীনের নিকট। চীন মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর হতেই মিয়ানমারের জন্য নির্ভরযোগ্য শক্তি এবং প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হয়েছে। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের অং সান সু চিকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে দাঁড় করাতে এবং মিয়ানমারকে সাময়িক প্রভাব হতে বের করার সর্বতো চেষ্টা আপাতদৃষ্টে সফল হয়নি এবং রোহিঙ্গা নিধনের পর পশ্চিমা বিশ্বের হতাশা পরিষ্কার দৃশ্যমান হয়েছে। এ হতাশার সুযোগ নিয়েছে চীন যার প্রতিফলন ঘটেছিল নভেম্বর ২০১৭ সালের মিয়ানমারের সাময়িক বাহিনীর সর্বধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন হ্লিং-এর চীন সফর এবং তার পরপরই অং সান সু চি’র চীন সফরের মাধ্যমে।
পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে ‘রোহিঙ্গা’ সঙ্কটে সমর্থন দিলেও রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ২০১৭ সালের শেষের দিকেও রোহিঙ্গা উৎখাত থেমে থাকেনি। মিয়ানমার বিগত তিন দশক ধরেই রাখাইন অঞ্চল হতে রোহিঙ্গা উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল। বিভিন্ন কৌশলে প্রথমে ‘রেঙ্গুন’ বর্তমানের ইয়াঙ্গুন হতে ক্রমান্বয়ে বিতাড়িত করে যাচ্ছে। রেঙ্গুন হতে রাজধানী নাইপেডুতে স্থানান্তর করাতে রাজধানী শহর ‘রোহিঙ্গা শূন্য’ হয়েছে। রেঙ্গুনের নেতৃস্থানীয় ‘রোহিঙ্গারা’ নির্যাতন হতে বাঁচতে ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। এরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাম পরিবর্তন করেও রেহাই পায়নি। এমনি একজন হউসান মং যিনি বুথিডং হতে সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি হতে ২০১১-১৫ সংসদ সদস্য রোহিঙ্গা নেতা ছিলেন। ২০১৫ সালের পর তাকে শুধু নির্বাচন হতে নিষিদ্ধই করা হয়নি বরং তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে মামলা করা হলে তিনি দেশত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, বর্তমানে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
উত্তর রাখাইনের সাথে বাংলাদেশের অভিন্ন সীমান্ত থাকার কারণে ওই অঞ্চলের রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বহুবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তেমনটি সম্ভব হয়নি দক্ষিণ বঙ্গোপাসাগরের আন্দামান সাগরের তীরবর্তী, এককালের আকিয়াব, বর্তমানের সিতওয়ে অঞ্চলের ভাগ্যাহত রোহিঙ্গাদের সিতওয়েতে বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায় সৎ প্রতিবেশী হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করছিল, সে অবস্থানের পরিবর্তন হয় ২০১২ সালে বৌদ্ধ এবং মুসলমান রোহিঙ্গা দাঙ্গার পর। ওই দাঙ্গার পর সিতওয়ে শহরের এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে একত্রে করে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরিত ক্যাম্পে রাখা হয়। এদের মধ্যে যাদের নাগরিকত্বের সনদ ছিল সেগুলোও নিয়ে নেয়া হয়। ওই ক্যাম্প হতে সহজে বের হতে দেয়া হয় না। খাদ্যাভাবে রয়েছে লক্ষাধিক ‘রোহিঙ্গা’। এরা ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হবে অথবা পর্যায়ক্রমে হত্যা করা হবে। এমনটাই মনে করেন ইয়াঙ্গুনে থাকা রোহিঙ্গা মূলের প্রাক্তন শিক্ষক মি. হউ কেউ মিন। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে, মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গা’ মূল্যের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকবে না। ক্রমেই হয় তাদের হত্যা করা হবে বা বিতাড়িত করা হবে- তাতে কারোই সন্দেহ নেই।
এ পরিকল্পনা প্রায় দু’দশক পুরাতন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহযোগিতায়। একদিকে যেমন মুসলিম তথা আরাকানের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা ছাড়ানো হচ্ছিল, অপরদিকে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হাত শক্ত করা হচ্ছিল। মিয়ানমারের সাময়িক বাহিনী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শক্তির পরিচয় পেয়েছিল জুন ১৮, ১৯৮৮ সালে যখন রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় ১০ লাখ মানুষের সমাগমে পাঁচ লাখ জমায়েত হয় রেঙ্গুন তথা মিয়ানমারের প্রধান পেগোডা সোয়েদাগনের সামনে। যেখানে যোগদেন গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই আন্দোলনের নাম ছিল ৮৮৮৮। আন্দোলনটি গণকদের পরামর্শে আগস্ট ৮, ১৯৮৮ সালে শুরু হয়েছিল ৮-৮-৮৮। ওই আন্দোলন ছিল সু চির পক্ষে এক ধরনের গণজাগরণ। এর মাধ্যমে বৌদ্ধ পুরোহিতদের যেমন শক্তি প্রদর্শিত হয় তেমনি মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে ‘ভিক্ষু’ শক্তির পরিচয় দেয়।
পাঁচ লাখ মানুষের সমাগম হয় রেঙ্গুন শহরে। মান্দালয়াতে প্রায় এক লাখ এবং সিতওয়েতে ৫০ হাজার যার মধ্যে রোহিঙ্গারাও যোগ দিয়েছিল। সামরিক বাহিনীর গুলিতে মিয়ানমারে প্রায় ৩ হতে ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। হাজার হাজার মানুষ থাইল্যান্ড সীমান্তে পালিয়ে যায়, যার মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সশস্ত্র দলে যোগদান করে। এর মধ্য দিয়ে উত্থান হয় অং সান সু চি’র। ১৯৮৮ সালের গণজাগরণের জের হিসেবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল নে উইন। এতগুলো বছর একঘরে হয়ে থাকা মিয়ানমারের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এ গণঅভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮তে সামরিক অভ্যুত্থানের পর। দেশের শাসনভার গ্রহণ করে ‘স্টেট ল’ এন্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল’। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর হতে সু চি গৃহবন্দি থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য তার সংগ্রাম অব্যাহত থাকে যার সপক্ষে দাঁড়ায় পশ্চিমা বিশ্ব। দ্বিতীয় সামরিক জান্তা পুনরায় অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে পড়ে।
১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উঠে আসা বৌদ্ধে ভিক্ষুদের ক্ষমতা দৃষ্টি এড়ায়নি পরবর্তী সামরিক সরকারের। সামরিক সরকার অতি সুচারুভাবে এ শক্তিকে তাদের সপক্ষে আনতে যে কৌশল অবলম্বন করে তার শিকার হয় রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য মুসলমান জনগোষ্ঠী। ক্রমেই মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তরুণ ভিক্ষু ভিরাথু-এর মুসলমানবিরোধী অবস্থানের প্রভাবে কট্টরপন্থী হয়ে উঠে সামরিক জান্তা। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সামরিক সরকার ২০০৩ সালে ভিরাথুকে গ্রেফতার করে ২০ বছরের কারাদন্ড দিলেও প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন-এর রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন জানালে তাঁকে ২০১২ সালে মান্দালয় জেল হতে মুক্তি দেয়া হয়। ক্রমেই ভিরাথু সামরিক জান্তার সহযোগিতা এবং মুসলমানদের বিশেষ করে রোহিঙ্গা বিরুদ্ধোচরণের কারণে, কট্টর বৌদ্ধদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ভিরাথু জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলমান রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে ঘৃণা ছড়াতে থাকেন। তার মতে, বাংলা হতে আগত ও মুসলমান ক্রমেই মিয়ানমারকে ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হলে মিয়ানমারও মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ভিরাথু মুসলমানবিরোধী এ আন্দোলন ৯৬৯ আন্দোলন নামে অধিক পরিচিত। ৯৬৯ বৌদ্ধদের একটি পবিত্র নম্বর। ভিরাথু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে বাংলা হতে বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাসনের জন্য দায়ী করে রোহিঙ্গাদের তাদেরই উত্তরসূরি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন।
তৎকালীন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিরাথুকে মুসলিমবিরোধী এবং বৌদ্ধ সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করাতে দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি প্রতিউত্তরে বলেন যে, মিয়ানমারের এ ভিক্ষুর অপমান মানে সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এবং ধর্মের অপমান। থেইন সেইন-এর পৃষ্ঠপোষকতার কারণে মিয়ানমারের তেরভেদা বৌদ্ধশক্তির জন্ম নেয়। উগ্রধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জন্মের মাধ্যমে সাধারণ মানুষও রোহিঙ্গা মুসলমানদের বহিরাগত বাঙালি হিসেবে ঘৃণা করার সংস্কৃতি তৈরি করে। এ কারণেই বেশিরভাগ তেরভেদা বৌদ্ধ রোহিঙ্গা উৎখাতে সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযানকে সঠিক মনে করে। মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাব সাধারণ মানুষের কাছে এমনই যে, রোহিঙ্গা নিধনকে ধর্মরক্ষার উপায় মনে করে এবং মনে করা হয় যে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তেরভেদা বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষাকবচ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রোহিঙ্গা নিধন এবং চিরতরে বিদায় করার কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমর্থন বহুগুণে বেড়েছে।
মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত কথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি। তাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব তার ভাবমর্যাদাকে আকাশস্পর্শী করে তুলেছিল। অপরদিকে, ১৯৯০ দশক থেকেই মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সু চিকে সমর্থন করে সামরিক জান্তার রোষাণলে পড়ে রোহিঙ্গারা। তথাপি ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর সমর্থনে যে গণহত্যা পরিচালিত হয়, তার সপক্ষে সু চি’র অবস্থান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হতাশ করেছে। রোহিঙ্গা নিধনে সু চি’র অবস্থান ধিকৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাজ্য অং সান সু চিকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আপোষহীন সংগ্রামের জন্য যে সব সম্মাননা দিয়েছিল তার প্রায় সবক’টিই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যান্য পশ্চিমা দেশও প্রত্যাহার করেছে তাদের প্রদত্ত সম্মাননা।
পশ্চিমা বিশ্ব সু চিকে যে পর্যায়ে উঠিয়েছিল তা যে ভুল ছিল সেটা তারা বুঝতে পেরেছে লেগেছে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গানিধনের পর। সু চি সামরিক বাহিনীর এ হত্যাযজ্ঞ এবং রোহিঙ্গা উৎখাতে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ সমর্থন যেভাবে দিয়েছেন তাতে মোহভঙ্গ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের, যার প্রতিফলন রোহিঙ্গা বিষয়ে পশ্চিমাদের অবস্থান। জাতিসংঘ এ রোহিঙ্গা নিধনকে একাধিকবার গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। জাতিসংঘের এ অবস্থান যথেষ্ট শক্ত ছিল, কিন্তু তাতেও মিয়ানমারের অবস্থানের তেমন পরিবর্তন হয়নি বা হচ্ছে না।
রাখাইন রাজ্যের আদি বাসিন্দা রোহিঙ্গারা দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে জন্মভ‚মি হতে যেভাবে উৎখাত হয়েছে তা সহজে মেনে নিতে পারছে না এ নিপীড়িত নিগৃহীত জনগোষ্ঠী। তারা নিজেদের দেশে সম্মানের সাথে ফিরে যেতে চায়। ফিরে যেতে চায় তাদের মাতৃভ‚মিতে নাগরিক হিসেবে। তাদের এ ন্যূনতম চাওয়া সহজে মিয়ানমারের বর্তমান সরকার পূরণ করবে না বলে মনে হয়। মিয়ানমার এত সহজে এদের কেন ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তেমন কোনো যুক্তি এ মুহূর্তে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যে জনগোষ্ঠীর উপরে অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচার হয়েছে সেখানে নিরাপত্তাই প্রধান বিষয়। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের এক ধরনের সমঝোতা হয়েছে সেখানে যে সব শর্ত দেয়া হয়েছে তা মোটেই বাংলাদেশের সপক্ষে ছিল না। ১৯৯২ সালের সমঝোতা যদি ভিত্তি হয় তবে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে যাবে। মিয়ানমার ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া বাকি রোহিঙ্গাদের এখন আর ফেরত নেবে না, যে কথা তারা সরাসরি জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি তথ্য মতে, প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা, যা হয়তো এখন বেড়েছে তাদের ভবিষ্যত কি পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা পোষণকারী উর্দু ভাষাভাষীদের মতো হবে? এ জনগোষ্ঠী প্রায় ৪৫ বছর বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের প্রায় তিন প্রজন্ম এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের প্রায় তিন প্রজন্ম এখনো বাংলাদেশে রয়ে গিয়েছে। এদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। রোহিঙ্গাদের বাদবাকি এ ৪০ হাজারের সাথে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে থাকবে, এরা থাকবে রাষ্ট্রহীন। এমন মানবতার বিপর্যয়ের নৈতিক দায়িত্ব অবশ্যই বিশ্ববিবেককে নিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের অবশ্যই আগ্রহ রয়েছে, তবে তা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় তেমন সন্তুষ্ট হতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কথিত ছয় লাখ ইহুদি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা শক্তি ইহুদিদের জাতিগত নিধন থেকে রক্ষা করতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করেছিল। বিগত চার দশক রোহিঙ্গারা বিশেষ করে ২০১৭ সালে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে তা একেবারেই বিরল। কাজেই যেখানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাতটি অঞ্চল রয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য আরেকটি অঞ্চল তৈরি করার দাবি বেশ যৌক্তিক। এসব দাবি মিয়ানমারকে বিবেচনা করতে হবে এবং এ যৌক্তিক দাবির সমর্থনে বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় একটি জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তা হবে মানবতার জন্য কলঙ্ক।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার স্ব-ইচ্ছায় নিয়ে যাবে এমন মনে করা যায় না। তবে আন্তর্জাতিক চাপে ভবিষ্যতে কিছু অগ্রগতি হলেও নিশ্চয়তা দিতে হবে নিরাপত্তার। অতীতে এ নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা বজায় রাখতে একাধিক রোহিঙ্গা নেতার কালাদান নদীর উত্তরে উত্তর রাখাইনকে একটি আলাদা অঞ্চল (Region) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি ও আন্দোলন করেছিল। এ দাবি এখনো বলবত রয়েছে। মিয়ানমারকে উত্তর রাখাইনে আরাকানের একটি অঞ্চল গঠন করতে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসন হবে না। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে একবিংশ শতাব্দীতে নিশ্চিহ্ন হতে দেয়া যেতে পারে না।
লেখক : সাবেক নির্বাচন কমিশনার
সূত্র : বার্মার রোহিঙ্গারা, গণহত্যার ইতিহাস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন