দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের প্রধান নিয়ামক বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অনৈতিক যোগসাজশ ভাঙতে না পারলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদ আর আমলাদের যোগসাজশেই দুর্নীতি হয়। রাজনীতিবিদেরা চাইলেই দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ সম্ভব। বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক যদি ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে দুদক বেশি দূর আগাতে পারবে না উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব অভিমত ব্যক্ত করেন। গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজ কার্যালয়ে এক সেমিনারে এমন মত দিয়েছেন বক্তারা। দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের শেষ দিনে এ সেমিনারের আয়োজন করে সংস্থাটি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভিসি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অনৈতিক যোগসাজশ ভাঙতে না পারলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ও তার পোষ্যদের সম্পদের উৎসসহ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দেশেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা হলফনামা দিয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। কিন্তু কেউ যদি মিথ্যা হলফনামা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে এদের প্রতি জনগণ আস্থা রাখবে কীভাবে? তিনি আরো বলেন, দুদকের উচিত চিহ্নিত বড় দুর্নীতিবাজদের শুধু ডেকে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ না করে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রশাসনের নিয়োগ-বাণিজ্য,পদায়ন ও বদলি-বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা।
সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়তে হলে সরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি, পদায়ন, শৃঙ্খলা ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন নীতিমালা প্রয়োজন। রাজনৈতিক জবাবদিহির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনী দুর্নীতি প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই নির্বাচনে জিতে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। তাঁদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ওঠে। বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক যদি ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে দুদক বেশি দূর আগাতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি দমন হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দুর্নীতিবাজরা যদি বেঁচে যায়, তাহলে বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দুর্নীতি প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক। নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দলগুলোর মনোনয়ন-বাণিজ্যের ওপর দৃষ্টি দিতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন অসম্ভব। সরকারদলীয় এমপি এ কে এম রহমতউল্লাহ বলেন, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনিক কর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে না পারলে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়।
সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, সব দুর্নীতিই দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয় এটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। আমলারা যদি চেয়ারের মায়া ত্যাগ করে আইনানুগভাবে তাঁদের সব দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে কারও পক্ষেই দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। অনৈতিক যোগসাজশ ছাড়া কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হতে পারে না।
বিএফইউজে-এর সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলের সঞ্চালনায় সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন দুদকের কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম, অপর কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদ আইনজীবী এম আমীর উল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফ, অধ্যাপক জেরিনা জামান খান, আবুল কাশেম মজুমদার ও নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, মোজাম্মেল বাবু, আইনজীবী তানিয়া আমীর প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) সাবেক রেক্টর এ জেড এম শফিকুল আলম। প্রবন্ধে শফিকুল আলম দুর্নীতির নানা ধরন তুলে ধরেন। রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচ্যুতিকে রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। বড়মাপের দুর্নীতির ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন