শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হত্যার পর দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা ছিল দীপা ও কামরুলের

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রংপুরের অতিরিক্ত জজ আদালতের পিপি এ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্রভৌমিক বাবুসোনা হত্যাকান্ডের সহস্য উন্মোচন এবং ঘাতক স্ত্রী দীপা এবং তার প্রেমিক কামরুল মাষ্টারকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসছে একের পর এক ন্যাক্কারজনক তথ্য। গ্রেফতারকৃত দীপা ভৌমিক এবং তার প্রেমিক কামরুল মাষ্টারও পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নৃশংস এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপাভৌমিকেরপ্রেমিক কামরুল ইসলাম। তার পরিকল্পনাতেই ২৯ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে গলায় ওড়নাপেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় আইনজীবী রথিশ চন্দ্রকে। হত্যার পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। সূত্র জানিয়েছে, আইনজীবী রথিশের সঙ্গে তার স্ত্রীর প্রায়ই কলহলেগে থাকতো। এছাড়া একে অপরের মধ্যে অবিশ্বাস, অশান্তি, স্ত্রীকে সময় নাদেয়া, স্ত্রীকে হাত খরচের পর্যাপ্ত টাকা নাদেয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক আগে থেকেই সংসারে কলহ লেগে থাকত। অনেক আগে থেকেই দীপা ভৌমিকের চাল-চলন ভালো ছিল না। অনেকটাই উচ্ছৃঙ্খল টাইপের আচরণ ছিল তার মাঝে। পর পুরুষের প্রতি আসক্তি ছিল তার মাঝে। এসব পছন্দ করতেন না স্বামী বাবু সোনা। এসব নিয়েও প্রায়ই ঝগড়া হত।
স্বামী এ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্র তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সহ সভাপতি থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ৮ই অক্টোবর হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে। একই দিনে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ পান কামরুল ইসলাম। নিয়োগ প্রাপ্তির কিছুদিন পর থেকেই তিনি ঐ স্কুলেরই জনৈক এক শিক্ষকের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার সাথে ঘনিষ্ঠতা চলে বেশ কিছুদিন। পরে আরেক শিক্ষকের সাথেও ঘনিষ্ঠতা হয়। এর কিছুদিন পর স্বামী বাবুসোনার সহকারী মিলনমোহন্তের সাথে ঘনিষ্টতা হয়ে যায়। এভাবে কিছুদিন চলার পর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহকর্মী কামরুলের সাথে পরামর্শ করতে থাকেন দীপা। সাংসারিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে গিয়েই ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় এবং দু’বছর আগে প্রেমের সূত্রপাত হয় তাদের। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে অন্য পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পুর্বের সম্পর্কগুলো বেশিদিন স্থায়ী না হলেও কামরুলের সাথে সম্পর্ক স্থায়ী হয় এবং তাদের এ সম্পর্কের বিষয়টি এক পর্যায়ে অনেকটাই ওপেন সিক্রেটভাবে চলতে থাকে। মাঝে মাঝে কামরুল প্রেমিকা স্নিগ্ধার বাসায় রাতও কাটাতো। এসব নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দীপার সাথে রথিশের ঝগড়া হত।
সুত্র মতে, গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং বিয়ের প্রস্তাবদেয় কামরুল। স্নিগ্ধাসেই প্রস্তাবে প্রথমত রাজি না হলেও পরকীয়া চালিয়ে যেতে থাকে। আর তাদের পরকীয়ায় যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন সেজন্য দু’ম মাস আগে রথিশ চন্দ্রভৌমিককে হত্যার পরিকল্পনা করেন কামরুল ও স্নিগ্ধা। হত্যার পর গোপনেদেশ ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন সিগ্ধা-কামরুল। এজন্য তারা সবকিছু গুছিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু হত্যাকান্ডের পর আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতায় পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি তারা।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত কামরুলকে গত বৃহস্পতিবারথেকে কামরুলকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। আর রথিশের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার এবং তার দুই ছাত্ররোকন ও সবুজ পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মেয়ে অদিতী ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া খুনের ঘটনায় তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ও সহকারী মিলনমোহন্তকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
দীর্ঘ জবানবন্দিতে যা বলেছেন স্বামী ঘাতক দীপা ভৌমিক
জেএমবি’র হামলায় নিহত জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও এবং মাজার খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন রথিশ চন্দ্রভৌমিক। এছাড়া দেবোত্তর সম্পত্তি এবং আরও কিছু বিষয় নিয়ে দ্ব›দ্ব-কলহের মাঝে ছিলেন রথিশ। ইতিপূর্বে তাকে অজ্ঞাত নামা ব্যক্তি হুমকিও দিয়েছিলেন। এ সুযোগটাই কাজে লাগান স্ত্রী দীপা ও তার প্রেমিক কামরুল। ধারণা ছিল এ সময় তাকে খুন করলে সবাই ভাববে জঙ্গিরাই তাকেমেরেফেলেছে। মুলতঃ এই ভাবনাথেকেই তাকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী দীপাভৌমিক।
বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল) রাতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন তিনি। এদিন রাতদেড়টা পর্যন্ত রংপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আরিফা ইয়াসমিন মুক্তার খাস কামরায় প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিদেন। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেছনের গেট দিয়ে দীপা ভৌমিক, কামরুল ইসলাম এবং দুই সহযোগী রোকন ও সবুজকে আদালতে নেয়া হয়।
দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক অবিশ্বাস, পারিবারিক অশান্তি, অবজ্ঞা, একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক থাকাসহ নানা কারণে স্বামী রথিশকে হত্যা করেছেন বলে ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেনে দীপাভৌমিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, দীপা তার জবানবন্দিতে জানান, ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের দাম্পত্য জীবন কখনওই সুখের ছিল না। তার স্বামীও পরকীয়ার লিপ্ত থাকায় তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। তাকে অবজ্ঞা-অসম্মান করত।কেউ পরস্পরকে বিশ্বাস করতেন না। তাকে অবিশ্বাস করার জন্য তিনিও স্বামীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। এর মধ্যেই তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলামের সঙ্গে তারপ্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টিজেনে যাওয়ায় স্বামীর সঙ্গে তার কয়েক দফা ঝগড়া হয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেন কামরুলকে তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু পথের কাঁটা হিসেবে স্বামী রথিশকে সরাতে হবেভেবে দুই জন মিলে দুই মাস আগে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যার পর কীভাবে লাশ গুম করা হবেসে সিদ্ধান্তওনেয়া হয়। রথিশজেএমবির হাতে নিহত ওসিহোসি কোনিও এবং মাজার খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। ওই দুই মামলায় জঙ্গিদেরযেহেতু ফাঁসির আদেশ হয় তাই পরিকল্পনা ছিল রথিশকে হত্যা করে বিষয়টি জঙ্গিরা করেছে বলে প্রচার করা। হত্যার পর লাশ গুমের জন্য মাটি খুঁড়ে গর্ত করা ও মাটি চাপাদেয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল দুই ছাত্রকে। এ জন্য তাদের ৩’শ টাকাদেয়া হয়। এছাড়াও তাদের উপবৃত্তির টাকা প্রদানসহ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেদেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কামরুল। এ বিষয়ে আদালতে স্পষ্ট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে দুই ছাত্র সবুজ ইসলাম (১৭) ওরোকনুজ্জামান (১৭)। আদালত তাদের জবানবন্দি গ্রহণশেষে কিশোর বয়স বিবেচনা করে যশোর শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে এবং অপর আসামি দিপাকে রংপুরকেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশদেন।
এদিকে, হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে আরও একাধিক ব্যক্তিকে খুঁজছে পুলিশ। লাশ নিয়ে যাওয়া ভ্যান চালক ছাড়াও পরিবারের আরওকেউ জড়িত আছে কি না এবং আরও অন্য কারও ইন্ধন আছে কি না ইত্যাদি বিষয় খতিয়েদেখছে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা। এছাড়াও হত্যাকান্ডের আগে এ্যাডভোকেট রথিশের ব্যাংক থেকে উত্তোলনকৃত মোটা অংকের টাকার সন্ধানেও মাঠে নেমেছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, গত ২৯ মার্চ রাতে খাবারের সাথে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে গলায় ওড়নাপেঁচিয়ে আইনজীবী রথিশকে হত্যা করে স্ত্রী দীপা ভৌমিক ও তার প্রেমিক কামরুল। ৫ দিন পর স্ত্রীর দেয়া তথ্যানুযায়ী স্বামী এ্যাডভোকেট রথিশের লাশ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন