মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ চার ॥
অবশ্য পরবর্তীতে ইতিহাস রচনার এ দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে বিরাজ করেনি। বরং এ দুটি ধারা মিলে একটি সামগ্রিক রূপ গ্রহণ করে। ঐতিহাসিক রশীদুদ্দীন খানের রচিত ইতিহাস গ্রন্থই এর স্বাক্ষর বহন করে। এখানে আম্বিয়ায়ে কিরাম, নবী করীম (সা.) এবং খলীফাগণের জীবন ও কর্ম যত ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছে যাজক সম্প্রদায় তথা রোমান, পারস্য, চীন, ভারত, মঙ্গলীয় শাসকগণের জীবন ও কর্ম। গ্রন্থটি একাধারে আরবী ও ফার্সি ভাষায় রচিত হয়েছে। অবশ্য বৃহদাকারের এ গ্রন্থটির বিরাট অংশ এখনো মুদ্রণের অপেক্ষায় আছে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেই মুসলিম সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। হজ্জ ও বাণিজ্য উপলক্ষে দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা যে কত উন্নত ছিল ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা থেকেই তার প্রমাণ মেলে। বালাজুরী ও ইবন জাউজী লিখেছেন যে, ‘বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ডাক প্রেরণ করা হত। এর বিস্তৃতি ছিল সুদূর তুরস্ক থেকে মিশর পর্যন্ত। এমনকি সরকারী ডাকের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকরা তাদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র প্রেরণ করতে পারত। খলীফা হযরত উমরের নির্দেশে তখন থেকেই এ নিয়মটি প্রবর্তন করা হয়। ডাক বিভাগের কর্মকর্তাগণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর গাইড বা পথ-নির্দেশিকা তৈরি করতেন। এ সমস্ত পুস্তিকায় যাত্রাপথের প্রতিটি অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ থাকত। এগুলো বিন্যস্ত করা হত বর্ণমালা অনুসারে। কোন কোন ক্ষেত্রে এ বিবরণ থাকত বিস্তারিত, কোন কোন ক্ষেত্রে আবার সংক্ষিপ্ত। এভাবেই রচিত হয় ভূগোল বিষয়ে নানা গ্রন্থ। পরবর্তীতে এগুলোই মুসলমানদের অন্যান্য বিষয়ে গভীর ও বৈজ্ঞানিক চর্চায় অনুপ্রাণিত করে। টলেমির রচিত ভূগোল গ্রন্থ আরবীতে অনূদিত হয়। অনুরূপভাবে অনুবাদ করা হয় সংস্কৃতি ভাষায় রচিত ভারতীয় লেখকদের বহুগ্রন্থ। এ সময়ে মুসলমানরা দীর্ঘ সফর ও সমুদ্রযাত্রার বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করে। সফরনামা ও সমুদ্রযাত্রার কাহিনী প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের জ্ঞান বাড়িয়ে দেয়। ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে সবকিছুই হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখর মতো একটি মানসিকতার সৃষ্টি হয়।
ভূগোল সম্পর্কে মুসলমানদের যে কত গভীর জ্ঞান ছিল, ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর একটি উক্তি থেকেই তার স্বাক্ষর মেলে। একবার মু’তাজিলা সম্প্রদায়ভূক্ত এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা (র.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুটি কোথায় অবস্থিত? জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, তুমি যেখানে বসে আছ ঠিক ওটাই হল পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। বলে রাখা আবশ্যক যে, যদি কারো মধ্যে এ ধারণা থাকে যে, পৃথিবী গোলাকার, কেবলমাত্র তার পক্ষেই এ ধরনের একটা জবাব দেওয়া সম্ভব।
মুসলমানরাই সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করেন। সেখানেও পৃথিবীকে তারা বৃত্তাকারে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ হিসাবে এখানে ইব্ন হায়কলের অঙ্কিত মানচিত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। মানচিত্রটি এত নিখুঁত যে, সেখানে ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নিকট প্রাচ্যের দেশগুলোকে সনাক্ত করতে কোন বেগ পেতে হয় না। সিসিলির রাজা রজারের (১১০১-৫৪) জন্য একটি ম্যাপ তৈরি করেছিলেন ভূগোলবিদ ইদ্রিস। এ ম্যাপটিতে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যন্ত এমন নিখুঁতভাবে স্থান পায় যে, তা সবাইকে চমকে দেয়। এমনকি এই মানচিত্র নীলনদের উৎস মুখটিও দেখান হয়েছিল। স্মরণ রাখতে হবে যে, আরব মুসলমানগণ দক্ষিণকে চিহ্নিত করেছেন উঁচু অঞ্চলে আর উত্তরকে নিম্নাঞ্চল হিসাবে। সমুদ্রপথে চলাচলের সুবিধার্থে দ্রাঘিমা ও অক্ষাংশের বিচিত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। একই কারণে মুসলমানদের মধ্যে জ্যোতিষ চর্চা এবং নৌ-চর্চা বিদ্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
স্কানডিনিভিয়া, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে খনন কার্য চালিয়ে মুসলমান শাসন আমলের হাজার হাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবে এ শাসন আমলের হাজার হাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবে এ শাসন আমলের হাজার হাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মধ্যযুগে মুসলমানদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। ব্যবসা উপলক্ষে তারা অনায়াসেই দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতেন। খ্যাতিমান একজন মুসলিম নাগরিকের নাম ইব্ন মাজিদ। ভাস্কো-ডা-গামার ভারত অভিযাত্রার সময় ইব্ন মাজিদ ছিলেন নৌ-বহরের পাইলট বা প্রধান নাবিক। জানা যায় যে, এ অভিযাত্রাকালে ইবন মাজিদ দিক নির্দেশক যন্ত্র বা কম্পাস ব্যবহার করেছিলেন। বিশেষ করে বসরা থেকে চীন পর্যন্ত মুসলমানদের নৌ-সফর ছিল খুবই বিস্ময়কর। এ ক্ষেত্রে তারা যে নৈপূণ্য ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন তা সবাইকে চমকে দেয়। ইংরেজিতে বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের মধ্যে রয়েছে আরসেনাল, এডমিরাল, মনসুন, ট্যারিফ ইত্যাদি। এ শব্দগুলো উদ্ভব হয়েছে মূল আরবী ভাষা থেকে। বহুকাল যাবৎ পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর মুসলমানদের যে কত ব্যাপক প্রভাব ছিল, এ শব্দগুলো থেকে সহজেই তা অনুমান করা যায়।
জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। তারা বেশ কিছু জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার করেন এবং এগুলোর উপর ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা করেন। তারা এ সমস্ত জ্যোতিষ্কের নামকরণ করেন আরবী ভাষায়। মজার ব্যাপার এই যে, পাশ্চাত্য জগতেও এ সমস্ত জ্যোতিষ্ক মুসলমানদের দেয়া আরবী নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বিজ্ঞানী ইবন রুশদ, সূর্যের পৃষ্ঠদেশের দাগকে প্রথম সনাক্ত করেন। উমর খইয়াম বর্ষ পঞ্জিকার ব্যাপক সংস্কার করেন। ফলে তা গ্রেগরীয়ান বর্ষ পঞ্জিকা অপেক্ষা বহুগুণে উন্নততর রূপ লাভ করে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই বেদুঈন আরবরা ক্ষুদ্র আকারের একটি মানমন্দির নির্মাণ করেছিল। প্রধানত অন্ধকার রাতে মরু অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের কাজে তা ব্যবহৃত হত। তাছাড়া আবহাওয়া, বৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজেও এটা ছিল বিশেষ উপকারী। কিতাবুল আনওয়া শিরোনামের গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে সংস্কৃত, গ্রীক এবং অন্যান্য ভাষায় রচিত পুস্তকাবলী আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এ সমস্ত পুস্তকের তথ্য বা বর্ণনার মধ্যে প্রচুর বৈপরীত্য বা পরস্পর বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে প্রকৃত সত্য নিরূপণ ও এ সমস্ত তথ্য যাচাই করার জন্য নতুন নতুন পরীক্ষা শুরু হয়। প্রয়োজন পড়ে দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণের। নির্মিত হয় অসংখ্য পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
খলীফা আল-মামুনের শাসনামলেই পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এ পরিমাপটি ছিল খুবই নিখুঁত। এ সময়ে জোয়ার ভাটা, সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা, রংধনু প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। বিশেষ করে সালাত কায়েম এবং সিয়ামের সময়সূচির সঙ্গে চন্দ্র-সূর্যের গতিবিধিকে তারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানে কুসংস্কার বা কল্প-কাহিনীর কোন স্থান নেই। এখানে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য এবং এটাই হল ইসলামী বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলমানদের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি ছিল ভারী চমৎকার ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিজ্ঞান চর্চার শুরুতে অপরিসীম ধৈর্য সহকারে তারা আরবী ভাষায় যতগুলো টেকনিক্যাল শব্দ আছে তার একটি তালিকা তৈরি করেন। টেকনিক্যাল শব্দগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা অসাধারণ ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে পদ্যে লেখা কিংবা গদ্যে লেখা নানা ধরনের পুস্তক-পুস্তিকা অধ্যয়ন করেন। শব্দ সংগ্রহের পাশাপাশি তারা এগুলোর অর্থ, ব্যবহার এবং প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে উল্লেখ করেন। শব্দগুলোকে বিন্যস্ত করেন প্রাণিবিদ্যা, এনাটমি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ানুসারে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে এগুলো পরিমার্জন ও সংশোধন করেন। শব্দ তালিকার সঙ্গে যোগ করেন নতুন নতুন শব্দ। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান গ্রন্থ অনুবাদ করার সময় এ শব্দ তালিকা খুবই কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন