মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ পাঁচ ॥
অন্য ভাষায় রচিত গ্রন্থসমূহ আরবীতে অনুবাদ করার সময় বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় রচিত গ্রন্থসমূহ অন্য ভাষায় রূপান্তর করার সময় আরবী শব্দ দ্বারা অনুবাদ পুস্তকগুলো ভারাক্রান্ত হয়নি।
উদাহরণ হিসাবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের উল্লেখ করা যেতে পারে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা ও পুস্তক রচনাকালে তারা প্রতিটি পারিভাষিক শব্দ আরবী ভাষা থেকে গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা কোন বিদেশী শব্দই ব্যবহার করেননি। তবে যে সমস্ত উদ্ভিদ আরব দেশে জন্মায় না, কেবলমাত্র সেগুলোর ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। দিনাওয়ারী (মৃ. ৮৯৫ খৃ.) নবম শতাব্দীতে কিতাব আন-নাবাত, ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বৃটানিকা রচনা করেন। বৃহদাকারের ৬টি খ-ে এগুলো সংকলনও করা হয়। অথচ গ্রীক ভাষায় রচিত জীববিদ্যার কোন বই তখনো অনূদিত হয়নি।
বিজ্ঞানী সিলবারবার্গ মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে বলেন, উদ্ভিদ বিদ্যা সম্পর্কে গ্রীকদের বিজ্ঞান চর্চা হাজার বছরের। ডায়সেকোরাইডের এবং থিওফেরাটাস-এর হাতে উদ্ভিদ বিদ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিকাশ লাভ করে। এরপরও এ কথা সত্য যে, মুসলিম উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দিনাওয়ারীর একক সফলতা ছিল গ্রীকদের সম্মিলিত সফলতার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তিনি কেবলমাত্র উদ্ভিদের দৃশ্যমান অবস্থা সম্পর্কেই আলোচনা করেননি, বরং চিকিৎসা কাজে উদ্ভিদের ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং অন্যান্য গুণের প্রতিও আলোকপাত করেন। এমনকি বৈশিষ্ট্য অনুসারে উদ্ভিদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন, আলোচনা করেন উদ্ভিদের প্রাপ্তিস্থান এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। মুসলমানদের হাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বিশেষ করে শল্য চিকিৎসা, ঔষধ বিজ্ঞান, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল বিস্ময়কর। এমনকি তদানীন্তনকালেই পেশাদার চিকিৎসক হওয়ার জন্য একজন ডাক্তারকে রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে সনদপত্র গ্রহণ করার নিয়ম চালু হয়।
স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, রোমান, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল মুসলিম জাহানের অভিন্ন সীমানা। এ সমস্ত দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মুসলমান বিজ্ঞানীদের নিবিড় সংযোগ ছিল। ফলে এ সমস্ত দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তার সবটুকুরই সমাবেশ ঘটেছিল মুসলমানদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত তারা ইতিমধ্যে অর্জিত জ্ঞানের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, দ্বিতীয়ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তারা আরো মৌলিক অবদান রাখেন। এমনকি শরীরে রক্ত চলাচলের তথ্যাদিও মুসলমানগণ কর্তৃক আবিষ্কারের ফসল। ইব্ন নাফিসের রচনা থেকেই এ কথা জানা যায়। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণের মধ্যে আল-রাজী, ইব্ন সিনা ও আবুল কাশেম বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের রচনা এবং গবেষণাকর্ম বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। কিছুকাল পূর্বেও তাদের গবেষণাকর্মকে পাশ্চাত্যের চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা হত।
আলোক বিজ্ঞানে উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। নবম শতাব্দীতে আল-কিন্দির রচিত রশ্মি বিষয়ক গ্রন্থ এখনো মওজুদ রয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তদানীন্তন গ্রীকদের রচিত বিজ্ঞান গ্রন্থের চেয়ে আল-কিন্দির গ্রন্থ ছিল বহুগুণে অগ্রসর ও উন্নতমানের। হায়সাম ছিলেন আল-কিন্দির একজন সার্থক উত্তরসুরী। তিনিও তার গবেষণাকর্মের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
প্রধানত দুটি কারণে খনিজ বিজ্ঞানের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য খনিজ সম্পর্কে জানাটা জরুরি। দ্বিতীয়ত, মূল্যবান পাথরের মধ্যকার গুণাগুণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খনিজ বিজ্ঞান ছিল খুবই সহায়ক। এ ব্যাপারে রাজা-বাদশাহ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল বেশি। খনিজ বিজ্ঞানের উপর আল-বেরুনীর গবেষণা কর্ম এখনো বিশেষভাবে ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ইব্ন ফিরনাস (মূ. ৮৮৮) একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি বহুদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। একটি দুর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তার গবেষণাকর্মকে অব্যাহত বা চূড়ান্তভাবে রূপ দেয়ার জন্য কোন বিজ্ঞানী এগিয়ে আসেননি। ফলে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উড্ডয়ন সম্পর্কিত গবেষণা কর্মের যবনিকাপাত ঘটে। কোন কোন বিজ্ঞানী এমন কতকগুলো কলকব্জা আবিষ্কার করেন যেগুলোর সাহায্যে পানির তলদেশে নিমজ্জিত জাহাজকে অনায়াসেই তোলা যেত। এ যন্ত্রের সাহায্যে বিরাটাকারের বৃক্ষকেও সহজে উপড়ে ফেলা সম্ভব হত। তাছাড়া পানির তলদেশের জগত ছিল মুসলমান বিজ্ঞানীদের জ্ঞান চর্চার একটি অন্যতম ক্ষেত্র। তারা মুক্তা, ঝিনুক ও মৎস্য চাষের উপর গভীর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তাদের রচিত গবেষণাধর্মী গ্রন্থের সংখ্যাও যথেষ্ট। বন্য পশু ও প্রাণীর প্রতি আরব-বেদুঈনদের প্রবল আকর্ষণ ছিল। তারা প্রাণীজগতের জীবন দারা সম্পর্কে চর্চা করে প্রচুর আনন্দ পেত।
মুসলিম প্রাণী বিজ্ঞানীদের মধ্যে আল-জাহিযের (মৃ. ৮৬৮) স্থান ছিল সবার শীর্ষে। তিনি প্রাণীবিদ্যাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীতে আল-কাযবিনী, দামিরী ও মিওকাওয়াই প্রাণী বিজ্ঞানী
হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এমনকি তদানীন্তনকালে গৃহপালিত পশু ও বন্য প্রাণীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হত। মুসলমান বিজ্ঞানীগণ এ সমস্ত বিষয়েও অসংখ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য কুরআনুল করীম মানুষকে তাকীদ দিয়েছে। তাকে আরো অনুপ্রাণিত করেছে আসমান-যমীনকে কিভাবে মানবজাতির অধীনস্থ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নিরলস চর্চা করতে আর সে কারণেই ইসলামে যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। তাই দেখা যায় যে, ইসলামের প্রাথমিক যামানা থেকেই মুসলমানগণ রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা চর্চায় গভীর মনোনিবেশ করেন। খালিদ ইব্ন যায়িদ (মৃ. ৭০৪), ইমাম জা’ফর আস্ সাদিক (র.)কে বলা হয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ। জাবির ইব্ন হাইয়্যান ছিলেন তাদেরই একজন কৃতি ছাত্র। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্মের জন্য আজও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের গবেষণা কর্মের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা অনুমানের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষণের উপর নির্ভর করতেন। তারা তথ্য সংগ্রহ করতেন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তাঁদের হাতে পড়েই প্রাচীনকালের রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে নতুন নতুন তথ্য যোগ হয়। তাছাড়া এ তথ্যগুলো ছিল প্রমাণযোগ্য। এভাবেই রসায়ন শাস্ত্র একটি বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করে।
জাবির ইব্ন হাইয়ানের হাতে রসায়ন বিদ্যা খুবই প্রসার লাভ করে। সে আমলেই তিনি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভস্মীকরণ (ঈধষরহধঃরড়হ) এবং লঘুকরণ (জবফঁপষরবং) পদ্ধতির কথা জানতে পারেন। তিনি ছিলেন বাষ্পীকরণ, ঊর্ধ্বপাতন, ঘণীভূতকরণ প্রভৃতি কলাকৌশলের আবিষ্কারক। এটা জানা কথা যে, বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রার জন্য মুসলমানদের যুগ যুগ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানীগণের গবেষণা কর্ম ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পাশ্চাত্য জগতে এ গ্রন্থগুলো দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তক হিসাবে চালু ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান যে মুসলমানগণের কাছে কতখানি ঋণী, মুসলমানগণ বিজ্ঞান চর্চার যে কতখানি অগ্রসর ছিলেন এ ঘটনা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অংক শাস্ত্র উন্নয়নে মুসলমানরা যে অবদান রেখেছেন তা কখনো মøান হওয়ার নয়। এলজেব্রো, জিরো, সাইফুর প্রভৃতি শব্দের উৎপত্তি আরবী ভাষা থেকেই। আর মুসলমান অংক বিশারদগণ এগুলোর আবিষ্কারক। মুসলমান অংক বিশারদগণের মধ্যে খাওরিজমী, উমর খাইয়াম, আল-বেরুনী খুবই খ্যাতিমান। এদের তুলনা চলে ইউক্লিডের সঙ্গে। সাধারণভাবে অংক চর্চায় গ্রীকদের ব্যাপক খ্যাতি থাকলেও ত্রিকোণমিতি ছিল তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা বিষয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুসলমানরাই ছিলেন অংশ শাস্ত্রের এ শাখার উদ্ভাবক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন