শিরীন আখতার
ষোল বছরের ফরিদ টেম্পোর হেল্পার হিসেবে কাজ করত ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি শেরপুর থেকে ফেরার পথে গাবতলী বাস টার্মিনালে এক ডাকাতির ঘটনার তদন্তকালে পুলিশ জনতার মধ্য থেকে ফরিদকে আটক করে। নয় দিন থানা হাজতে আটক থাকাকালীন ডাকাতির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করানোর জন্য পুলিশ তাকে নিয়মিত মারধর করে। পুলিশ ফরিদের অভিভাবককে তার আটক সম্পর্কে কোন খবর দেয়নি। নয় দিন পর তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলে সেখানে সে আরো পাঁচ মাস অবস্থান করে। এরপর তাকে পাঠানো হয় টঙ্গীর সংশোধন প্রতিষ্ঠানে। তার অভিভাবক দারিদ্র্যের কারণে এখন পর্যন্ত তাকে এই আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারেনি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন আইনবলে শিশুদের আটক রেখে তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী যেসব ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও বাংলাদেশের শিশু আইন ১৯৭৪-এ বর্ণিত অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরদানকারী প্রথম সারির দেশগুলোর অন্যতম। ওই সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সের সব মানুষই শিশু। তবে বাংলাদেশের দ-বিধিতে অপরাধের দায়দায়িত্বের বয়স সম্পর্কে বলা হয়েছে ৯ বছর পর্যন্ত শিশুর বিরুদ্ধে কেউ যদি কোন অপরাধের অভিযোগ আনে তবে তা আমলে নেয়া হবে না। তাকে আটক বা আদালতে চালান করা যাবে না। আর ১৪ বছর বয়সে কারো ক্ষেত্রে যদি আদালত মনে করে যে অপরাধ বিষয় বুঝবার ক্ষমতা বা পরিপক্বতা তার হয়েছে তবে কেবল সেই শিশুর বিচার হতে পারে। আর ১৯৭৪ সনের শিশু আইনে বয়সসীমাটা ১৬ বছর করা হয়েছে। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি যে চৌদ্দ থেকে ষোল বছর বয়সের শিশুদের বিচার হতে পারে।
১৪ বছরের ঈমনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে তার বাবা তাকে টঙ্গীর কিশোর আদালতে নিয়ে আসেন। ঈমনের বাবা জানান, ঈমন তার বন্ধুদের সাথে অনেক বেশি সময় কাটায় যা তিনি আশা করেন না। কখনো কখনো সে রাতে বেশ দেরি করে বাসায় ফেরে। ঈমন সবসময়ই তার বাবার আদেশ-উপদেশ অবহেলা করত যার জন্য তিনি বাধ্য হয়ে তাকে সংশোধন কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ঈমনকে ছয় মাসের আটকাবস্থা দেয়া হয়। এখন সে জানে কিভাবে ড্যাগার ও অন্যান্য তীক্ষè অস্ত্র তৈরি করা যায়। সে জানায়, যখন সে ছাড়া পাবে তখন সে এসব কাজই করবে কারণ সে চায় তার বাবা জানুক সংশোধন কেন্দ্রে সে কত ভালোভাবে সংশোধিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেনের বিচার ও সহিংসতা কর্মসূচির প্রধান হাবিবুন্নেসা বললেন, ‘আমাদের দেশের কিশোর উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে যেসব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেসব বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয়। কেন্দ্রগুলো থেকে বেরিয়ে এসে এসব শিশু সমাজে তাদের অবস্থানটি খুঁজে পায় না। কারণ কেন্দ্রগুলোতে তারা যা শেখে তা মানসম্মত তো নয়ই আবার তাদের প্রশিক্ষণের কোন সনদপত্রও থাকে না। এই সব শিশুর জন্য রাষ্ট্রের উচিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যাতে তারা এখান থেকে বেরিয়ে নিজেদের জায়গা খুঁজে নিতে পারে। তাদের যাতে পুনরায় একই অপরাধমূলক কাজে ফিরে যেতে না হয়।’
শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শিশুদের প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯১ সালে শিশুদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্ব কর্মপরিবেশনা গৃহীত হওয়ার পর প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে সব প্রয়াস সত্ত্বেও বিশ্বের শিশুদের জন্য এখনো তেমন কোন সুখবর নেই। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিশু রাস্তায় থাকে।
বাংলাদেশের ১৯৭৪ সনের শিশু আইনে আছে, যদি দেখা যায় যে কোন শিশু অপরাধ করেছে তাহলে প্রথমে পুলিশকে দেখতে হবে যে অপরাধ সংঘটনের পেছনে অন্য কারা আছে এবং তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাবিবুন্নেসা জানান, ‘ষোল বছরের নিচে যেসব শিশু অপরাধে জড়ায় তাদের কৃতকর্মের পেছনে কারা জড়িত আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। শিশুকে নয়, শিশুকে যারা ব্যবহার করছে তাদের খুঁজে বের করে বা শিশু যে কারণে সহিংস আচরণ করছে তা অনুসন্ধান করে সেসবের সমাধান করতে হবে। আইনের মানে শাস্তি নয়। আইন হচ্ছে সংশোধনের জন্য। শিশুদের যেসব অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য সেসব অপরাধও পুনরায় বিবেচনা করতে হবে শুধুমাত্র তারা শিশু বলে। এমনকি যেসব শিশু চূড়ান্তরকম অবাধ্য ও উচ্ছৃঙ্খল তাদের ক্ষেত্রেও ১৯৭৪-এর ধারা-৫১তে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।’
শিশু আইন ১৯৭৪-এর ধারা-৫১তে বলা হয়েছে কোন শিশু যদি কোন কিশোর আদালতে অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া যাবে না। ধারা-৫২তে বলা হয়েছে তাকে একটা নিরাপত্তামূলক আটকাবস্থায় রাখা যেতে পারে আঠার বছর বয়স পর্যন্ত। আবার কেউ যদি শিশুর জামিনের জন্য আসে তাহলে দ-বিধির ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৭ ধারার বিধান অনুযায়ী তাকে জামিন দিয়ে দিতে হবে। এমনকি দৃত্যুদ-যোগ্য এবং যাবজ্জীবন কারাদ-যোগ্য মামলা হলেও তার জামিনের বিধান রয়েছে। ধারা-৫৩তে বলা হয়েছে, আদালত দোষী কিশোরকে শাসনের পর ছেড়ে দিতে পারে প্রবেশন অফিসার বা উপযুক্ত অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে যাতে সে সমাজের মধ্যে থেকেই সংশোধিত হয়।
১৯৭৪-এর শিশু আইনে আছে কোন শিশুর যদি অভিভাবক না থাকে তবে আইন ওই শিশুর দায়িত্বগ্রহণকারী ব্যক্তিকে তার অভিভাবক হিসেবে অনুমোদন দেবে। শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হলে শিশু আইন ১৯৭৪ এবং প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০-এ বিশদভাবে বলা আছে আটক শিশুকে থানা হাজতে রাখা যাবে না, তাকে তার অভিভাবকের কাছে জামিনে দিতে হবে। বয়স্কদের সাথে শিশু একসাথে অপরাধ করে থাকলেও শিশুর বিরুদ্ধে আলাদা অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে এবং আলাদাভাবে কিশোর আদালতে তার বিচার হবে।
এ প্রসঙ্গে এডিশনাল এটর্নি জেনারেল বললেন, ‘শিশুর বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের বিশেষ ভূমিকা থাকবে যেন বিচারকালীন সময়ে শিশুটিকে উত্ত্যক্ত করা না হয়। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন তাকে যেন কেউ প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে কিংবা ভীত সন্ত্রস্ত না করে সে ব্যাপারে বিচারক দৃষ্টি দেবেন। শিশুর শাস্তির ব্যাপারে যেসব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যেমন-শিশুকে মৃত্যুদ- না দেয়া, শাস্তিকালীন সময়ে নিবন্ধনকৃত সংশোধন প্রতিষ্ঠানে রাখা, প্রবেশনে থাকলে কি হবে প্রভৃতি ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও সেভ দ্য চিলড্রেন (ইউকে)র যৌথ অনুসন্ধান শেষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সারাদেশের ৬৫টি কারাগারে ১ হাজার ২০০-এর বেশি শিশু আছে উল্লেখ করা হয়। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারাদেশের ৬৪টি জেলায় শিশু বন্দির সংখ্যা পাওয়া যায় ১০২৫ জন এবং ৩টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২২৬ জন (সেভ দ্য চিলড্রেন (ইউকে)।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ও আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘চিলড্রেন ইন ট্রাবল উইথ ল’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলেছেন, ‘কারাবন্দি শিশুদের অধিকাংশই অস্ত্র, মাদক বা বিস্ফোরক আইনে মামলার আসামি। হরতালের মত রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে পিকেটিং ঠেকানোর জন্য এবং কর্মসূচি চলাকালে গোলযোগের কারণে পুলিশ এসব শিশুর ঢাকার রাস্তা থেকে গণহারে আটক করে। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য বা অস্ত্র আইনে মামলা দিয়ে থাকে। এছাড়া মাদক পরিবহন ও বিক্রির কাজে শিশুদের ব্যবহার করে এক শ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী। এ কাজেও শিশুরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলো শিশুদের দারিদ্র্যকে কাজে লাগায় নিজেদের স্বার্থে। সবার আগে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের স্বার্থে শিশুদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
সেভ দ্য চিলড্রেনের হাবিনুন্নেসা বললেন, ‘শিশু অধিকার রক্ষার্থে বর্তমানে তিনটি বিষয়ের পরিবর্তন খুব জরুরি। প্রথমত, শিশুদের পুলিশ হেফাজত থেকে সামাজিক হেফাজতে আনার জন্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে ১৯৭৪-এর শিশু আইনের ধারা-৪৮ ও ৫০-এর ব্যবহার করতেই হবে এবং তৃতীয়ত, ধারা ১৫ অনুযায়ী পৃথক বিচার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ কাজে প্রত্যেক জেলায় একজন সেশন পাওয়ার হোল্ডার জজ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।’
২০০২ সালে আইনের সাথে সংঘাত থেকে শিশুদের অধিকার রক্ষায় সরকারের সাতটি মন্ত্রণালয়, এটর্নি জেনারেল, স্থানীয় সরকার, সমাজসেবা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউকে ও আরো ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়েছে এবং কমিটি শিশুদের অধিকার রক্ষায় নীতিমালা তৈরি, প্রণয়ন ও অন্যান্য অসামঞ্জস্য দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছে।
-নিউজ নেটওয়ার্ক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন