জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা : কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরেই তৈরি প্রাথমিক অবকাঠামো : পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৩ সালে
রফিকুল ইসলাম সেলিম : মাতারবাড়িতেই হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর (ডিপ সী-পোর্ট)। সেখানে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জাহাজ ভিড়ার চ্যানেল ও টার্মিনালকে ঘিরে ইতোমধ্যে এই সমুদ্র বন্দরের প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। এখানে রয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো সুবিধাও। এই বাণিজ্যিক বন্দরে প্রথম পর্যায়ে দু’টি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সেখানে ৩২০ থেকে ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) আট হাজার টিইইউএস কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে আগামী ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হবে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে এই গভীর সমুদ্র বন্দর। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত চীনের সহায়তায় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে সংশয় থেকে গেলেও কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে নির্মিত হবে বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন এই গভীর সমুদ্র বন্দর। এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। পোর্ট, শিপিংখাত সংশ্লিষ্টদের মতে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে মাইলফলক হবে নতুন এই সমুদ্র বন্দর।
গতকাল (সোমবার) চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে ‘মাতারবাড়ি বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণ’ শীর্ষক এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠান জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সির (জাইকা) বিশেষজ্ঞরা মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চ্যানেল ব্যবহার করে বাণিজ্যিক বন্দর তথা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। কর্মশালায় গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জাইকার বিশেষজ্ঞ মি. শিমাদা, মি. গোশিমা, মি. ওতাম, মি. সুজুকি এবং মি. সাতো। ইতোমধ্যে জাইকা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কারিগরি সম্ভাব্যতার সমীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। জাইকার বিশেষজ্ঞরা কর্মশালায় জানান, মাতারবাড়িতে এ সমুদ্র বন্দরটি জাপানের কাশিমা বন্দর এবং নিগাতা (পূর্ব) বন্দরের মডেল অনুসরণ করে নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ সমুদ্রের কিনারা নয়, জাহাজ চলাচলের চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে সমুদ্রের সাথে যুক্ত করা হবে।
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (দি বিগ-বি)’ শীর্ষক উদ্যোগের আওতায় জাপান সরকার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছিল। এ পর্যায়েই মাতারবাড়িতে বাণিজ্যিক, গভীর সমুদ্র বন্দরের সম্ভাবনা উদঘাটিত হয় জাইকার গবেষণায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ জেটি-বার্থ টার্মিনাল নির্মাণের সাথে গভীর সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো জাপান সরকারের অর্থায়নে সম্পন্ন করা হবে। অবশিষ্ট এ অবকাঠামো বিনির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি ডলার। মাতারবাড়ি বাণিজ্যিক বন্দরের পরিচালনা ও তত্ত¡াবধানের দায়িত্ব পালন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জাইকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে যে ক’টি সমুদ্র বন্দর রয়েছে তার কোনটিই গভীর সমুদ্র বন্দর নয়। ফলে ডীপ ড্রাফটের ভেসেল এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। তাই ডীপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতারবাড়িতে এ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজ, খোলাপণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারকে জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমানোর সাথে সাথে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ি ও মহেশখালী অঞ্চলে গড়েউঠা শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্যপরিবহনের সহযোগিতা করাই এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য।
জাইকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫শ’ টিইইউএস কন্টেইনার নিয়ে ভিড়তে পারে। অথচ পার্শ্ববর্তী কলম্বো, জহরলাল নেহেরু, করাচি ও চেন্নাই বন্দরে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ ভিড়তে পারে। এ বিবেচনায় মাতারবাড়িতে অধিক ড্রাফটের জাহাজের সমুদ্র বন্দর কন্টেইনার পরিবহনে বাংলাদেশের জন্য উত্তম বিকল্প হতে পারে। মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরে ৩২০ ও ৩৫০ দৈর্ঘ্যরে দু’টি টার্মিনাল হবে। এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। যার ফলে মাদার ভেসেলগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না। ফলে ফিডার জাহাজে করে কন্টেইনার আনা-নেয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরে ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসাথে ৮ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। এরফলে এখান থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কন্টেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের হিন্টারল্যান্ড কানেকটিভিটি উন্নয়নে ব্যাপক ভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে জাইকার অর্থায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া হয়ে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে। এ সড়ক যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সাথে। রেলপথ বিভাগ চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেটি ভবিষ্যতে মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে যুক্ত হবে। এরফলে এ সমুদ্র বন্দর ইন্টারমডাল কানেকটিভিটির আওতায় চলে আসবে। সেখানে একেকটি জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। ফিডার (ছোট) জাহাজের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কন্টেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ বলেন, দেশের আমদানি-রফতানির হার বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দ্রæত বাড়ছে। এ ব্যাপক সংখ্যক জাহাজ এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আরও একটি সমুদ্র বন্দরের বিকল্প নেই। সূচনা বক্তব্যে বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম বলেন, আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাজ শুরু হবে। ২০২৩ সালে একটি মাল্টিপারপাস জেটি ও একটি কন্টেইনার জেটি চালুর মধ্যদিয়ে এ গভীর সমুদ্র বন্দরের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন