পটুয়াখালীর বাউফলে দাশপাড়া গ্রামে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলো তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজিব হোসেন। গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর পান্থপথে যাত্রিবাহী দুই বাসের প্রতিযোগিতায় নিজের হাত হারিয়ে মুর্মুষূ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছিল সে। অবশেষে গত সোমবার মস্তিস্কে রক্ষক্ষরণের মধ্য দিয়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে। আগেই পিতা-মাতা হারানো এতিম এই তরুন ঢাকায় নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি দুই কিশোর ছোট ভাইয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করছিল। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি পরিবারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার যবনিকাপাত ঘটল। এভাবেই রাজপথে ঝরে যাচ্ছে অযশ্র প্রাণ। হাজারো মানুষ হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। রাস্তায় রাজিবের হাত হারানোর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য এবং জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঝুলে থাকা সময়ে দেশের কোটি মানুষের সহানুভুতির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূল ধারার গণমাধ্যমে দুর্ঘটনা ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যে আলোচনার ঢেউ লেগেছে তার সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও জড়িয়ে পড়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিক সমাজের আলোচনা-সমালোচনা ও দাবী-দাওয়া কোন নতুন বিষয় নয়। প্রতিটি চাঞ্চল্যকর সড়ক দুর্ঘটনার পর সড়ক নিরাপত্তা ও গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো নতুনভাবে আলোচনায় উঠে আসতে দেখা যায়। রাজিবের মৃত্যুর পর সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবী করলেন, এ মৃত্যুর জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনা দায়ী নয়। তবে বিরূপ সমালোচনার মুখে তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে দুর্ঘটনার জন্য গাড়ীচালকদের অদক্ষতা, ওভারটেকিং এবং সড়ক ব্যবস্থাপনাও দায়ী বলে স্বীকার করেন।
রাজিবের হাত হারানো ও মৃত্যুর ঘটনা যখন একটি স্পর্শকাতর ইস্যু, তখন ফরিদপুরে বাস-ট্রাকের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে আরেক তরুন খালেদ হাসান হৃদয় নিজের হাত হারিয়ে হাসপাতালের বেড়ে কাতরাচ্ছে। একই সময়ে রাজধানীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে গেছে ট্রাফিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের পা। গতকাল প্রকাশিত খবরে দেলোয়ারের অবস্থা অবনতিশীল বলে জানা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে যেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু ও ততোধিক মানুষ পঙ্গু-বিকলাঙ্গ হচ্ছে, সেখানে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া প্রতিটি মানুষের পেছনেই একেক ব্যক্তি ও পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের হৃদয়বিদারক গল্প লুক্কায়িত থাকে। ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা দায়সারা বক্তব্য শুনছি, ব্লেইমগেম ও আশ্বাসের বানীও শুনছি, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছিনা। সড়কের বিশৃঙ্খলা. অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে উচ্চ আদালত থেকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু রুলিং ও নির্দেশনা জারি করা হলেও তা বাস্তবায়নেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোন গরজ বা উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে যানজটের কারণে নাগরিক দুর্ভোগ আরো বেশী অসহনীয় হয়ে হয়ে উঠেছে। সড়ক-মহাসড়ক ও গণপরিবহণকে এমন প্রাণ সংহারি ভ‚মিকা থেকে মুক্ত করার জরুরী উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ এসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে গত বছর দেশে প্রায় ৫ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৩৯৭ জনের মৃত্যু এবং ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১৩টি বড় সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে কমপক্ষে ২০ জনের মৃত্যুসহ ৬৫জন মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ এক উদ্বেগজনক চিত্র। দুই বছর আগে ভারতের বোম্বের হাইকোর্ট এক মাইলফলক রায়ে সড়কপথের যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তাকে জনগনের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঢাকায় ফুটপাথের দখলবাজি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ফুটপাথ দখলমুক্ত করার নামে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোক দেখানো নানা নাটকীয় কর্মকান্ডও দেখা গেছে। বেশ কয়েক বছর আগে হাইকোর্টের এক রুলে ফুটপাথে মটর সাইকেল তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। গতকাল একটি ইরেজী দৈনিকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, রাজধানীর একটি ব্যস্ত এলাকার রাস্তায় ফুটপাথের উপর একসাথে অনেকগুলো মটরসাইকেলের জট লেগে আছে। মটরসাইকেল চালকরা পথচারীদের রাস্তায় বা গলিপথে চলাচলে বাধ্য করছে। এটি শহরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেপরোয়া চালকদের কারণে রাস্তায় বা গণপরিবহণে যেমন সাধারণ মানুষ নিরাপদ নয়, একইভাবে বেপরোয়া মটরসাইকেল চালকদের কারণে ফুটপাথের পথচারিরাও নিরাপদ নয়। এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব যেন পুলিশের নয়। রাস্তায় গাড়ি আটকে চাঁদাবাজি করলেও গণপরিবহনে যাত্রী নিরাপত্তা, বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা দূর করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেই উদাসীন অথবা ব্যর্থ। বেপরোয়া গাড়ী চালকদের মত সড়ক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষও যেন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদাসীন ও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আমাদেরকে কাজ করতে হয়, আর কাজের প্রয়োজনে রাস্তায় গণপরিবহণের উপর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য। রাস্তা ও গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, যানজট ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করা এই মুহুর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক ইস্যু। এ ইস্যুকে অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন