প্রথমবার ৫০ হাজার, পুনরাবৃত্তি হলে এক লাখ টাকা
ফারুক হোসাইন : দেশ থ্রিজি থেকে ফোরজিতে উন্নীত হয়েছে। প্রথম সাবমেরিনের পর দ্বিতীয় সাবমেরিনে যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকদের সেবার মান বাড়ানোর জন্য দেয়া হয়েছে টেক নিউট্রালিটি (তরঙ্গের নিরপেক্ষতা), নতুন করে তরঙ্গ। কিন্তু মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট গ্রাহকদের সেবার মান যেন নিচের দিকেই নামছে। নেটওয়ার্ক না থাকা, সীমাহীন কলড্রপ, ইন্টারনেট সার্ভিসও খুবই দুর্বল। খোদ রাজধানীতেই ফোরজি সিমে পাওয়া যাচ্ছে টুজি সিগনাল। জেলা শহরগুলোতে নামে ফোরজি হলেও টুজিতেই সীমাবদ্ধ ডাটা সার্ভিস। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ব্রডব্যান্ড সার্ভিসেই অসন্তুষ্ট গ্রাহকরা। দেয়া হয়না নির্ধারিত গতি, কারণে অকারণে সার্ভিসের নামে বন্ধ করে দেয়া হয় সংযোগ। মাস শেষে খারাপ সেবাতেও একই টাকা গুণতে হয় গ্রাহকদের। সবকিছু মিলিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট গ্রাহকদের।
সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্ট গ্রাহকদের জন্য এবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে কোয়ালিটি অব সার্ভিস নীতিমালায় জরিমানার বিধান যুক্ত করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে নীতিমালা লঙ্ঘনে নোটিশ দেয়ার বিধান থাকলেও এবারই প্রথম জরিমানার বিধান রাখছে কমিশন। সেবার মানের নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রতিটি সূচক (ভয়েস সেবার জন্য পৃথক সূচক, ইন্টারনেটের জন্য পৃথক) লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা এবং পুনরাবৃত্তি হলে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বিটিআরসি। ইতোমধ্যে কমিশন এই নীতিমালা প্রণয়ন করে অনুমোদনের জন্য ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তা বাস্তবায়ন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। গ্রাহকের সর্বাধিক অভিযোগ কলড্রপ নিয়ে। তারা বলছেন, কাউকে কল দেওয়ার পর ঠিকমতো কথা বলা যায় না কিংবা এক প্রান্তের গ্রাহক কথা শুনলেও অন্যপ্রান্তের গ্রাহক শুনতে পান না। ফলে পুনরায় কল করতে হয় এবং গচ্ছা যায় অতিরিক্ত অর্থ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন আরেক বিড়ম্বনা মিউট কল। এই কলে সচল থাকে নেটওয়ার্ক, হ্যান্ডসেটের পর্দায় এয়ারটাইম মিনিট গতিশীল থাকে, কিন্তু শোনা যায় না কথা তবে পরিশোধ করতে হয় বিল। এ ছাড়া ইন্টারনেটের গতি নিয়ে প্রতারণা, ইন্টারনেট ঠিকমতো কাজ না করলেও বিল কেটে রাখা, বিভিন্ন প্যাকেজ একবার চালু হওয়ার পর আর বন্ধ না হওয়া, এসএমএসের যন্ত্রণা, নেটওয়ার্কের আসা-যাওয়া, স্থানে-স্থানে কভারেজ না থাকা, বিভিন্ন ট্যারিফ/প্যাকেজ বিল নিয়ে প্রতারণা সংক্রান্ত আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা যেন নেই। বাধ্য হয়ে গ্রাহকরা তাদের ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির কথা তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই।
মোবাইল ফোন গ্রাহক নূরুল ইসলাম জানান, দুই দিনে একই অপারেটরের বিভিন্ন নম্বরে ফোন দিয়ে অন্তত ১০টি কলড্রপ ও মিউট কলের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। বিরক্ত হয়ে অপারেটরকে দুয়োধ্বনি শোনাচ্ছেন তিনি। একই অবস্থার কথা বলেছেন ইসমাঈল। এর আগে মোবাইল অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ফোনে কথা বলার সময় আমার কলটা যে ড্রপ হবে না তার কোনো গ্যারান্টি আমি পাইনি। এমনকি আমার মত একজন মন্ত্রী তার অফিসে বসে কথা বলতে পারে না, তার বাসায় বসে কথা বলতে পারে না। বাসায় থেকে অফিসে যেতে আটবার কল ড্রপ হয়। তিনি বলেন, এতদিন বলা হচ্ছিল টেক নিউট্রালিটি নেই তাই গ্রাহকদের ভালো সেবা দেয়া হচ্ছে না। কেন আমরা কোয়ালিটি দিতে পারি না কারণ আমাদের তরঙ্গ নেই। আমরা কিন্তু তরঙ্গের দরজা খুলেছি এবং টেক নিউট্রালিটি আমরা দিয়েছি। আমি আমার দরজাটা খুলে দিয়েছি। দয়া করে আপনারা যারা অপারেটর আছেন তারা এখন গ্রাহকদের বিষয়টা উপলদ্ধি করেন। গ্রাহকদের খারাপ সেবা দেয়াকে মেনে নেয়া যায় না। এটা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
তাই গ্রাহক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ‘এএনএস অপারেটরদের কোয়ালিটি অব সার্ভিস (সেবার মান) নীতিমালা ২০১৮’ এর ১১ অনুচ্ছেদে বিভিন্ন লঙ্ঘন বা পুনরাবৃত্তি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ এর ৬৫ ধারার আলোকে জরিমানা আরোপ করার বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, মোবাইল টেলিকম, আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার), পিএসটিএন (পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক), বিডবিøউএ (ব্রডব্যান্ড ওয়ারলেস এক্সেস) সহ সকল এএনএস (এডভান্স নেটওয়ার্ক সার্ভিস) অপারেটরদের টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নয়ন ও গ্রাহক স্বার্থ নিশ্চিত করতে কোয়ালিটি অব সার্ভিসের খসড়া রেগুলেশন প্রস্তুত করে কমিশন। ৯ সদস্যের একটি কমিটি প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোয়ালিটি অব সার্ভিস গাইডলাইন/রেগুলেশন এর নমুনা ভেন্ডারদের (এনিটেল, এনইসি, হুয়াওয়ে, নকিয়া) সুপারিশ, বিভিন্ন গবেষণাপত্র/প্রতিবেদন এবং আইটিইউ (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) ও এপিটি (অটোমেটিক প্রোগ্রামড টুলস) এর নির্দেশনা/সুপারিশ পর্যালোচনাসহ স্টেকহোল্ডারদের বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে একটি খসড়া রেগুলেশন প্রস্তুত করে। কমিশন ওই খসড়া পর্যালোচনা করে জানায়, মোবাইল ফোন সেবার ফোরজি/এলটিই এর ডাটার গড় গতি হবে ৭এমবিপিএস। তাছাড়া কারিগরি ও প্রযুক্তির পরিবর্তন, তরঙ্গ প্রাপ্যতা ও ব্যবহার, বাজারের অবস্থা ইত্যাদি বাস্তব দিক বিবেচনা করে এই গতি সময়-সময় পরিবর্তন করা যাবে।
কমিশন এই শর্ত ভঙ্গের ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ আইনের ৬৫ ধারার আলোকে নির্দিষ্ট জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করার সুপারিশ করে। এক্ষেত্রে নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রতিটি সূচক (ভয়েস সেবার জন্য পৃথক সূচক, ইন্টারনেটের জন্য পৃথক) লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা এবং পুনরাবৃত্তি হলে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বিটিআরসি। একইসাথে কমিশন অপরাধের ধরণ অনুযায়ি সময় সময় জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করবে। ইতোমধ্যে কমিশন এই জরিমানার বিধান কোয়ালিটি অব সার্ভিস সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করে অনুমোদনের জন্য ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তা বাস্তবায়ন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় নানা নির্দেশনা দিয়ে থাকি। এবার এর সাথে জরিমানার বিধানটি যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই নীতিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তা বাস্তবায়ন করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন