গত নির্বাচন কমিশনকে কেউ কেউ সরকারের নির্বাহী প্রধানের কার্যালয়ের বারান্দা বা সম্প্রসারিত অংশ বলে অভিহিত করেছিলেন। কেন তারা একথা বলেছিলেন, ওই নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ ও ভূমিকার মধ্যেই তার প্রমাণ বিধৃত হয়ে আছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশবাসী তা ভালো করেই জানে। বিদেশীদের কাছেও তা অজানা নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন থাকলেও শুরু থেকেই সবাই আশা প্রকাশ করে আসছে, এই নির্বাচন কমিশন সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট থাকবে এবং তার কাজ ও ভূমিকার মাধ্যমে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী সত্ত¡ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। দু:খের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি, করার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টাও যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান নয়। বরং তার কিছু কাজ, উদ্যোগ ও পদক্ষেপ এবং নির্বাচন কমিশনার ও কর্মকর্তাদের কিছু কথা বা বক্তব্য বির্তকের জন্ম দিয়েছে। বিগত নির্বাচন কমিশনের দেখানো পথেই এ নির্বাচন কমিশন হাটছে, এমন ধারণাও অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে ‘সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যেই সকলের জানা হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন এ উদ্যোগ নিয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অন্যান্য প্রস্তাবের সঙ্গে ওই প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবের মূলকথা হলো, সংসদ সদস্যরা যাতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন, সেই মর্মে নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, যেসব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হচ্ছে, সেখানকার সংসদ সদস্যরা আচরণবিধির কারণে সেখানে যেত পারছেন না। তারা সেখানে বসবাস করছেন। সংসদ সদস্যদের ওপর যদি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, তাহলে সরকারী কার্যক্রম অচল হয়ে যাবে। কাজেই, নির্বাচনী আচরণবিধি যেন এমনভাবে সংশোধিত হয় যাতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের গতিবিধি ও চলাফেরায় বাধ্যবাধকতা না থাকে। তারা যেন স্বাভাবিক রাজনীতি ও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল আরো দুটি প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনের বিবেচনার জন্য পেশ করে। তার একটি হলো, আরপিও সংশোধনের বিষয়টি যেন আরো যাচাই-বাছাই পূর্বক উপস্থাপন করা হয়। অপরটি হলো, ২০০৮ ও ২০১৩ সালের মতো জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা যেন পুন:বহাল রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন ১৯ এপ্রিল তড়িঘড়ি করে একটি বৈঠক করে ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেছে। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটি পর্যালোচনা শেষে একটি সুপারিশ যত দ্রæতসম্ভব নির্বাচন কমিশনে পেশ করবে। তার ভিত্তিতেই গৃহীত হবেন সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুউদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, ‘সিটি কর্পোরেশন একটি বিশাল এলাকা। সংসদ সদস্যরা সেখানে বসবাস করেন ও যাতায়াত করেন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হলে তারা যাওয়া-আসা করতে পারেন না। আইন অনুযায়ী তারা শুধু ভোটের দিন ভোট দিতে পারেন। তাদের ওই সময় এলাকার বাইরে থাকতে হয়’, গোটা আলোচনা এই নিরিখেই হয়েছে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর এ উদ্যোগ কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে হেলালুউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নির্বাচনী আচরণবিধি যে কোনো সময় সংশোধন হতে পারে। আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দলভিত্তিক ছিল না, এখন দলভিত্তিক। কনটেক্সট পাল্টে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের চাপে এ উদ্যোগ কিনা, এরূপ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের স্টেক হোল্ডার। কোনো দল থেকে কোনো বিষয় উত্থাপন করা হলে আমরা আলোচনা করি।
নির্বাচন কমিশন সচিবের বক্তব্যে ক্ষমতাসীন দলের অভিমতের প্রতিফলন রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। একটি সূত্র মতে, বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের একাংশ সংশোধনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। অপরাংশ এর বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ‘ইতিবাচক অভিমত’ই গৃহীত হয়েছে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ১৫ মে। এর আগে নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধন করা সম্ভবপর নয়,এমন বক্তব্য দিয়ে সহজেই নির্বাচন কমিশন বিষয়টি যেতে পারতো। গত নির্বাচন কমিশনের এধরনের উদ্যোগের ব্যাপক সমালোচনা এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার প্রসঙ্গও নির্বাচন কমিশন তুলে ধরতে পারতো। এসব কোনো কিছুই তাকে করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ ক্ষমতাসীন দলের অন্যায্য ও অযৌক্তিক প্রস্তাব বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার দায়িত্বই যেন সে গ্রহণ করেছে।
গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৭ এপ্রিল ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল একটি দাবিনামা পেশ করেছে। ওই দাবিনামায় বলা হয়েছে, ১. নির্বাচনের সাতদিন আগে নির্বাচনী এলাকায় টহলসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ২. ওই দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মিথ্যা-বানোয়াট মামলা ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ৩. নির্বাচনী প্রচারণায় সকল দল ও প্রার্থীর সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ৪. নেতাকর্মী ও প্রার্থীর সমর্থকদের হয়রানি করা যাবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অফিসে অভিযোগ কেন্দ্র খুলতে হবে এবং ১২ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। ৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। ৬. সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে যে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে ইত্যাদি।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পর্কিত একটি মাত্র প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচন কমিশন বৈঠক করে ইতিবাচক অভিমত দিলেও বিএনপির সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সংক্রান্ত এতগুলো দাবির ব্যাপারে কোনোরূপ আলোচনা বা বৈঠকের আয়োজন করেনি। এমন কি আওয়ামী লীগের প্রস্তাব নিয়ে যেদিন বৈঠক হয়েছে সেদিনও এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। বিএনপির প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুউদ্দীন আহমদ যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই বোধকরি নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত ও শেষ বক্তব্য। সেদিন তিনি বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনা নির্বাচন কমিশনের নেই। ইভিএম-এর মতো প্রযুক্তি আইনানুগভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচনে। এবং বিএনপির কিছু প্রস্তাব আইনানুগভাবে বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন কমিশন। বিশেষ করে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ ইত্যাদি ইতিবাচকভাবেই বিবেচনা করা হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে সেনা মোতায়েনের পক্ষে নয় এবং ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। এ দুটি ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান আওয়ামী লীগেরই অনুকূলে।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদসদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে ইতোমধ্যে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। তারা কেউ কেউ এই উদ্যোগের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের বিপদের আশংকাও আন্দাজ করেছেন। উল্লেখ আবশ্যক যে, ২০০৯ সালে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারের বাইরে রাখার বিষয়টি বিধামালায় সংযুক্ত করে। পরে ২০১৫ সালে দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের পর মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ দেয়া না দেয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে গত নির্বাচন কমিশন। প্রাথমিকভাবে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ না করে সরকারি সুবিধাভোগীদের প্রচারের (যানবাহন ও প্রচার যন্ত্রবাদে) সুযোগ দিয়ে খসড়া তৈরি করে। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সরকারি সুবিধাভোগীদের সফর ও প্রচারণায় অংশ নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আচরণবিধি চূড়ান্ত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আচরণবিধি করা হয়। বলা বাহুল্য, যেসব কারণে সেদিন সরকারি সুবিধাভোগীদের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আচরণ বিধি প্রণয়ন করা হয়, সেসব কারণ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এও বলা যায়, কারণগুলো এখন আরো শক্তিশালী। এমতাবস্থায়, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দেয়া হলে নির্বাচন পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠার যে শর্ত রয়েছে, তা আর থাকবে না। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রæপের পরিচালক আবদুল আলিম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। যদি সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার অধিকার পান তবে তারা প্রচারে কিছু বিশেষ সুবিধা পাবেন। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সংসদ সদস্যরা প্রচারের সুযোগ পেলে তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। যেসব দলের সংসদ সদস্য নেই তারা বৈষম্যের শিকার হবে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হবে। সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকায় প্রচন্ড প্রভাবশালী। তারা প্রচারের সুযোগ পেলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের লেশমাত্র থাকবে না। বিএনপির তরফ থেকে এ উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংসদ সদস্যরা প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু থাকবে না। এই উদ্যোগে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় উন্মোচিত হয়েছে।
নির্মোহ বিচারে অবশ্যই একথা প্রতিষ্ঠিত হবে যে, ক্ষমতাসীন দলের প্রস্তাবটি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। সেখানে প্রশাসন থেকে সবকিছুই ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে সেখানে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের এই সুযোগ দাবি করা কেন, তা অনেকেরই বোধগম্য নয়। সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়ন কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার নামলে নির্বাচন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। সম্ভবত এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্যই দলটি এই দাবি তুলেছে। প্রশ্ন হলো, তার সুবিধায় তার দাবি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন নেবে কেন? নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি আরো গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। সরকারের নির্দেশিত পথে হাটলে তার প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা দ্রুতই প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাবে যা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সমস্যায় ফেলতে পারে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করা। নির্বাচনটি তখনই সফল নির্বাচন হিসাবে পরিচিহ্নিত হবে যখন তা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এরকম একটি নির্বাচন উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনকে সরকারি প্রভাবের বাইরে থেকে নির্বাচনটি পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যখন সকল মহল থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক তখন এই বিষয়টিও তার আমলে নিতে হবে। এমন অবস্থা, আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে যাতে সকল দল নির্বাচনে অংশ নিতে স্বত:র্স্ফূতভাবে এগিয়ে আসে। তৃতীয়ত, নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ করতে হলে সকল দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা একটি বড় শর্ত। সেটি নির্বাচন কমিশনকে করে দেখাতে হবে। চতুর্থত, বিনাবাধায় ও নির্ভয়ে ভোটাররা যাতে ভোট দিতে পারে সে জন্য বিশেষত নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিনে তাদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত, নির্বাচনে যে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদুপায় অবলম্বন ও দুষ্কৃতি প্রতিরোধ না করলে গণরায়ের যথার্থ প্রতিফলন হবে না। নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে আরো নানা বিষয় রয়েছে। সেগুলোও নির্বাচন কমিশনকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতা যাচাই করে দেখতে পারে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে পারে, সর্বোপরি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কতটা সচেতন ও সক্রিয় সেটা একটা বড় প্রশ্ন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের কিছু নির্বাচনসহ বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন পরিচালনা করেছে। এসব নির্বাচন সম্পর্কে পর্যবেক্ষক পর্যায়ে ও জনগণ পর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো কোনো নির্বাচনে সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন। আবার কোনো কোনো নির্বাচনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যথাযথ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা প্রমাণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে গত ২৮ ডিসেম্বর পৌরসভা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদের ১২৭টি পদের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতা হয়েছে। আবার গত ২৯ মার্চ যে ১২৭টি পদে সাধারণ ও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই নির্বাচনও হয়েছে ২৮ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অনুরূপ। এতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি গণআস্থা কমেছে। এরকম আস্থার সংকট নিয়ে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা এবং সাফল্য লাভ করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে, সেটা মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন নয়।
শুরু থেকেই পর্যবেক্ষক মহল বলে আসছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জ। আস্থা অর্জনের এই জায়গাটি, বলা যায়, এখনো প্রায় শূণ্যই হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশনের উচিৎ আস্থা অর্জনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। সর্বকর্মে নিরপেক্ষ থাকা, কোনো পর্যায়ে কোনো পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া এবং দায়িত্ব পালনে দৃঢ় ও আপোসহীন থাকার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তার প্রতি আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। সন্দেহ নেই, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের জন্য আরেকটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে ক্ষমতাসীন দলের প্রস্তাব তাকে যৌক্তিক কারণেই উপেক্ষা করতে হবে। এই নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয় সেটা ও তাকে যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন