ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ মহারাষ্ট্রের পুনের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল ভাতনগর। ঘুমন্ত প্রায় এই নগরীতে নীরব এক বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এই অঞ্চলের ‘কানজারভাত’ সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের তরুণীরা বিয়েতে কুমারীত্বের পরীক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। শত বছরের পুরনো এই রীতি ভেঙে কুমারীত্বের পরীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনছেন তারা। তাদের এ স্বপ্নে এখন সাহস জোগাচ্ছেন কানজারভাতের তরুণরাও। এই স¤প্রদায়ের শত বছরের পুরনো রীতি অনুযায়ী সাদা কাপড় পরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন বর ও কনে। সতীচ্ছেদের রক্তের দাগ সাদা কাপড়ে দেখিয়ে নিজের বিশুদ্ধতার পরীক্ষার প্রমাণ করতে হয় কনেকে। বিয়ের পরদিন স¤প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা বৈঠকে বসেন। সেখানে বরকে প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘মাল কি খাঁটি ছিল?’ কানজারভাত স¤প্রদায়ে ‘মাল’ বলতে কনেকে বুঝানো হয়। আধুনিক ভারতে মেয়েদের সতীত্বের পরীক্ষা বিরল একটি ঘটনা। দেশটিতে অল্প কিছু স¤প্রদায় এটি করে থাকে। এক সময়ের প্রায় একঘরে বহিরাগত কানজারভাত স¤প্রদায়ের জিপসি উপজাতির মধ্যে এই রীতি এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। কিন্তু হিন্দু প্রধান ভারতে স¤প্রতি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে পরিবর্তনের জোয়ার দেখা গেছে। দেশটিতে নিম্ন বর্গের মানুষরা শিক্ষা-চাকরি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও পুরোহিত সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় বেশ সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন তারা। কানজারভাত স¤প্রদায়ের তরুণ প্রজন্ম নারী অধিকারের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নারীদের সাহস দিচ্ছেন তারা। এই জ্যেষ্ঠরাই পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া সতীত্বের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জারি রাখতে চায়। কানজারভাত সম্প্রদায়ের ৫৫ বছর বয়সী লীলাবাই। সংসার ভেঙেছে তার, স¤প্রদায়ের মানুষের কাছে এক নামে পরিচিত তিনি। চার দশক আগে কীভাবে তিনি এই সতীত্বের পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টকে। লীলাবাই বলেন, তার বয়স তখন ১২ বছর। ‘এই সময় আমি কিশোরী।’ তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারিনি, কী ঘটছে আমার সঙ্গে।’ সতীত্বের পরীক্ষায় তীব্র ক্ষোভ থাকলেও এতদিন তা প্রকাশ করতে পারেননি লীলাবাই। এমনকি এই পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন তার কন্যারাও। বর্তমানে লীলাবাইয়ের নেতৃত্বে কানজারভাত স¤প্রদায়ের বিধবা আরো বেশ কিছু নারীর একটি গ্রুপ এই পরীক্ষার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। সমাজে যারা এ পদ্ধতি জারি রাখতে চান সেই নেতাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন বিধবা এই নারীরা। এ নিয়ে স¤প্রদায়ের মধ্যে ফাটল শুরু হওয়ার পর বিবেক তামাইচিকার নামে কানজারভাত স¤প্রদায়ের এক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ খোলেন। এই গ্রুপের সদস্যরা সতীত্বের পরীক্ষার অবসান চান। বিবেক তামাইচিকার চলতি বছরের শেষের দিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন। তিনি বলেছেন, তার বিয়েতে এই পরীক্ষা হতে দেবেন না তিনি। তিনি মনে করেন, এটা এক ধরনের অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষ্ঠুর কাজ। তামাইচিকার বলেন, যারা এ প্রাচীন রীতি অনুযায়ী বিয়ে করতে রাজি হবেন না, তাদের সমাজচ্যুত করার হুমকি দিয়েছে সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যরা। কানজারভাতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী এবং পুরুষরা বলেন, তামাইচিকার প্রচারণা সম্প্রদায়ের রীতিনীতিকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। কলেজে কীভাবে কানজারভাত স¤প্রদায়ের তরুণীরা হয়রানির শিকার হন সে অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরলেন বেশ কয়েকজন। তারা বলছেন, রাস্তায় হাঁটার সময় তাদের সহপাঠীরা অনেক সময় সাদা রুমালে লাল রঙ লাগিয়ে সেটি মেয়েদের দিকে তুলে ধরে। এছাড়া রাজ্যের বাইরে থেকে কানজারভাত সম্প্রদায়ের তরুণীদের বিয়ের প্রস্তাব আসাও অতীতের তুলনায় কমে গেছে। তবে সতীত্বের পরীক্ষার ব্যাপারে বহিরাগতদের কাছে সম্প্রদায়ের অনেকেই মিথ্যাচার করছে বলেও জানালেন বেশ কিছু নারী। লীলাবাই বলেন, তারা সবাই মিথ্যুক। তামাইচিকার বলেন, গ্রামের পঞ্চায়েত বা সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে অনেকেই ভয় পান। কথা বললে সমাজচ্যুতি অথবা হুমকির মুখোমুখি হতে পারেন তারা। ১৮৭১ সালের ঔপনিবেশিক আমলের আইনে কানজারভাত সম্প্রদায়কে অপরাধী উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই সময় থেকেই কানজারভাত সম্প্রদায় নিজেদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে না জানানোর পথ বেছে নেয়। এই সম্প্রদায়ে বিয়ে, খুন এমনকি অন্যান্য সব অপরাধের বিচার হয় পঞ্চায়েত নেতাদের সিদ্ধান্তে। ১৯৬০ সালের দিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে ভারত সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি ও নীতিমালা হাতে নিলেও ভাতনগরে তার ছোঁয়া লাগেনি। এখনো দারিদ্র্য কবলিত মহারাষ্ট্রের এই অঞ্চল। বিবেকের চাচাতো বোন প্রিয়াঙ্কা তামাইচিকার বলেন, তিনি প্রতিবাদকে পরিবর্তনের শুরু মনে করছেন। ‘আমি মনে করি, আমার স¤প্রদায়ে শুধুমাত্র আমিই একমাত্র তরুণী, যে মনে করে, এই পরীক্ষা সঠিক নয়।’ তিনি বলেন, আমি একজন নববধূকে মারপিট করতে দেখেছি। আমি দেখেছি, নারীরা তাদের রক্তাক্ত কাপড় দেখার জন্য ঘরে ঢুকছেন। আমার এই জীবনে আমি মনে করি, এদিন আমরা মুক্তি পাবো এবং তাদের দেখিয়ে দেবো যে তারা ভুল। একদিন আমি এমন কিছু করবোই। ওয়াশিংটন পোস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন