একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশের মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানো শুরু করেছে সরকার। ২২ জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন করার পরে এবার ৪৯২টি উপজেলায় ইউএনও পদেও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৩১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের এসিআর ও শৃঙ্খলা আমলনামা চাওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তার প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আগামী আগস্ট মাসে ৪৯২ উপজেলায় ইউএনও পদে পর্যায়ক্রমে নিয়োগ দেয়া হবে।
এদিকে আগামী ২৪ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরু হয়ে ২৬ জুলাই শেষে। সেখানেও ডিসিদের পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসছে। মাঠ প্রশাসনের এসব কর্মকর্তাই মূলত নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। সরকারের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের ভোট প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখতে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম তদারকি করতে হবে ইসিকে। সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু এখনো ছয় মাস বাকি। ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনে রদবদল শুরু হয়েছে।
নির্বাচনের আগে সরকারের যুগ্ম ও অতিরিক্ত সচিব পদে আরেক দফা পদোন্নতির প্রক্রিয়াও চলছে। একই সঙ্গে মাঠ প্রশাসনকে সুসংহত করার লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও অন্যান্য পদে রদবদল করা হবে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্রে জানা গেছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার বিএনপি নেতারাও প্রশাসনের ওপর নজর রাখতে শুরু করেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. মুয়াজ্জেম হোসাইন ইনকিলাবকে বলেন, ৪৯২টি উপজেলায় ইউএনও পদেও পরিবর্তন নয়, পদোন্নতি ও বদলি চলমান প্রক্রিয়া, সেই আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৩১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের এসিআর ও শৃঙ্খলা আমলনামা চাওয়া হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশি সময় নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার মাঠ প্রশাসনকে নিজেদের দখলে রাখতে চায়। বর্তমান সরকারও সেটা শুরু করেছে। তিনি আরো বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় ডিসি এবং ইউএনওরা সরাসরি কাজ করে, সে কারণে সরকার তাদের দখলে রাখতে চায়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা এই কাজ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে গতকাল সোমবার পর্যন্ত সচিব ৭৮ জন, অতিরিক্ত সচিব আছেন ৫০০ জন, যুগ্ম সচিব আছেন ৭৯৯ জন, উপসচিব আছেন এক হাজার ৭৬৫ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব আছেন এক হাজার ৪৩২ জন, সহকারী সচিব এক হাজার ১৯২ জন, বিভাগীয় কমিশনার আট জন, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১৪ জন, ডিসি ৬৪ জন, এডিসি ১৯২ জন এবং ইউএনও রয়েছেন ৪৪০ জন। বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে ইউএনও পদে ২৭,২৮,২৯, এবং ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে রয়েছেন। এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেককের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাদের প্রত্যাহার করে ৩১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে নিয়োগ দেবে সরকার। তবে ৩১তম ব্যাচের ২৫০ জনের মধ্যে ১৬২ জন কর্মকর্তার মধ্যে বেশির ভাগই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গত মার্চ মাসে সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন। সর্বশেষ গত বছরের ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ২ জুলাই সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে ২৬টি সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও সমস্যা নিয়ে সচিব সভায় আলোচনা হবে। এর আলোকেই আগামী জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের নিয়ে যে কোনো সময় বৈঠক করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, সচিবরা আগামী সংসদ নির্বাচন, দুর্নীতির দায়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়া, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা, সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রচার, সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কৌশল, নির্বাচনের আগে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আলোকে সরকারের বিগত প্রায় ৯ বছরের উন্নয়ন চিত্র, মেগা প্রকল্প, ডিজটাল বাংলাদেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, পদ্মসেতু ও মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, শিল্পখাতে সমৃদ্ধি, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচিসহ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ও ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের চিত্র, সরকার প্রধানের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ইস্যুর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মধ্যম আয়ের দেশ হতে শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ এক উন্নত দেশে পরিণত করার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার রুপকল্প ২০৪১। প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা স¤প্রতি মাঠ প্রশাসনের বড় ধরনের রদবদলের কারণে ধারণা করছেন, সরকার হয়তো আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যেই মাঠ প্রশাসন গুছিয়ে নিচ্ছে। অতীতে সকল সংসদ নির্বাচনের আগেই মাঠ প্রশাসনকে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার অবকাশ নেই।
চলতি বছরে ২৫ ফেব্রæয়ারি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরসহ ২২ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়াও ওইদিন পুলিশ সুপারসহ পুলিশে বিভিন্ন পদমর্যাদার শতাধিক কর্মকর্তারা বদলি ও পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
পরদিন তিন দফতরে নতুন মহাপরিচালক ও একটিতে চেয়ারম্যান নিয়োগসহ সরকারের ২২ জন অতিরিক্ত সচিবের দফতর বদল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গত ২০ ফেব্রæয়ারি প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী সচিব ও সমমর্যাদার ৩৯১ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর আগে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পান ১২৮ যুগ্ম সচিব এবং ২১ ডিসেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান ১৯৩ উপসচিব। এর পরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজেদের মতো করে নির্বাচনের মাঠ সাজাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সহযোগী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, দেশে আগাম নির্বাচন হবে। তারই আলামত হিসেবে হয়তো ডিসি-এসপি-ইউএনও বদলি ও পদায়ন করা হচ্ছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর ১৫ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাকে ইসির পরামর্শ ছাড়া বদলি করা যায় না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসকরা। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন ইউএনও’রা। তবে অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসারও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়।
প্রশাসনে একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, বদলি ও পদোন্নতি একটি রুটিন কাজ হলেও অনায়াসে বলা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ভালো সময় যাচ্ছে। এতে যে কোনো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি কর্মকর্তারা উৎসাহিত হবেন। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও গতি আসবে। এভাবে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অব্যাহত সহযোগিতা চায় সরকার। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তারা অতীতের যে কোনো সরকারের তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নূরুল হুদা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারে মেয়াদ ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি শেষ হবে। আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে অথবা ২০১৯ সালের প্রথম দিকে যে কোনো দিন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অংশ হিসেবে আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
জানা গেছে, আগামী জুলাই মাসে সচিব সভাকে সামনে রেখে জোরালো তৎপরতা চলছে প্রশাসনের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে। এ প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সর্বশেষ সচিব সভায় নেয়া ২৬টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সর্বশেষ তথ্য চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত বছরে ২ জুলাই অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সচিব সভায় ওই ২৬টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। যার অগ্রগতি জানতে স¤প্রতি তাগাদা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য দিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ইতোমধ্যে ওইসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সর্বশেষ তথ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এসছে। এগুলোর ওপর এখন প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন