দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর জনঅসন্তুষ্টি ও আস্থাহীনতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, মানুষ ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলছে। এর চিত্র পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বিগত কয়েক বছরের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর জন্য ব্যাংকের সেবার প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি দায়ী। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৮১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। এটা দেশের ব্যাংক হিসাবের সাড়ে ১২ শতাংশ। এর আগে ২০১৪ সালে ৮.৬০ শতাংশ গ্রাহক অসন্তুষ্ট হয়ে ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়। ২০১৫ সালে এ ধরনের গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯.৪২ শথাংশ। ২০১৬ সালে আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১১.৬৪ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই ব্যাংকের গ্রাহকের সংখ্যা কমছে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব গোটা অর্থনীতির উপর পড়ছে এবং এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংকিং খাতটি অর্থনীতির অন্যতম বৃহৎ খাতে পরিণত হয়েছে। আমাদের মতো ছোট একটি দেশে যে পরিমাণ ব্যাংক থাকা দরকার, তার চেয়েও অধিক ব্যাংক রয়েছে। দিন দিন তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে এ খাতে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়া নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙের ছাতার মতো নতুন নতুন ব্যাংক গজিয়ে উঠছে। অবশ্যই তা সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে এবং তার বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর ফলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ নিয়ে একটি ব্যাংকের চলার কথা তা সব ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হচ্ছে না। এসব ব্যাংকে মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলে অর্থ জমা রাখার পর দেখা যায়, তাদের অর্থ নিয়ে ব্যাংকের মালিক শ্রেণী ছিনিমিনি খেলছেন। মূলধন খেয়ে ব্যাংককে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে আমরা দেখেছি। নতুন ব্যাংকের ক্ষেত্রে যখন এ ধরনের অর্থ লুটের মতো ঘটনা ঘটে, তখন সংগতকারণেই গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত অর্থ নিয়ে শংকিত হয় এবং ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে অন্য ব্যাংকগুলোর উপর। দেখা যায়, যে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত এবং সুনামের সাথে বছরের পর বছর ধরে গ্রাহকসেবা দিয়ে আসছে, ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রভাব ঐ ব্যাংকটির উপরও গিয়ে পড়ছে। গ্রাহকদের মধ্যে দ্বিধা, সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক করছে। বাংলাদেশে ইমার্জিং ব্যাংকিং খাতটিতে মূলত আঘাত আসে বিগত এক দশকে। হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, সোনালি ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি ও লুটপাট এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকে চুরির ঘটনা নিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের প্রতি তাদের আস্থা কমে যায়। এই কয়েক দিন আগেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংক আমানত সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মনোমুগ্ধক ও প্রলুব্ধকর অফার এবং সুযোগ-সুবিধা দিয়েও আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে হিমশিম খাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকে আস্থার সংকট গ্রাহকদের দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ও সংশয় সৃষ্টি করে চলেছে। এছাড়া গ্রাহক সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আচরণও গ্রাহকদের কাছে অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তারা সরকারী চাকরি করেন বিধায় গ্রাহক সন্তুষ্ট হলো কি হলো না বা আমানত এলো কি এলো না এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকেও গ্রাহক সংখ্যা কমছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সেবার নামে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে সার্ভিস চার্জ কেটে নিচ্ছে, যা গ্রাহকদের কাছে কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হয় না। গ্রাহককে একটি এসএমএস দিয়ে তার তথ্য জানাবে এতেও ব্যাংক তার অ্যাকাউন্ট থেকে চার্জ কেটে রাখে। এছাড়া অনেক হিডেন চার্জ রয়েছে যা গ্রাহকের অজান্তেই কেটে রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার উপর গ্রাহককে তার আমানতের ওপর যে সুদ দেয়ার কথা তা এত অল্প যে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জেই তা চলে যাওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়ায়। ফলে ব্যাংকের চতুর্মুখী চালাকি ও যথাযথ সেবা না দেয়ার কারণে গ্রাহক বিরক্ত হয়ে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে চলে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের সার্বিক অর্থনীতি মন্দাবস্থা থাকায় বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগ ঋণাত্বক পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমে আছে। এর ফলে ঋণ নেয়ার হার কমে যাওয়ায় ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা দিতেও কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ফলে খরচ কমানোর জন্য অনেক ব্যাংক থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাঁটাই করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাঁটাই হয়েছে বলে জানা যায়।
ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ও অনাস্থার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বড় বড় আর্থিক কেলেংকারি এবং ঋণ নেয়ার নামে লুটপাটের কারণে এ খাতটি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। বলা বাহুল্য, এসব অনিয়ম ও আর্থিক কেলেংকারির সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মের পক্ষে অর্থমন্ত্রীকে কখনো কখনো সাফাই গাইতেও দেখা গেছে। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে তিনি কোনো ‘টাকাই না’ বলে অনেকটা ‘সেফগার্ড’ দিয়েছিলেন। এছাড়া বেসিক ব্যাংসসহ অন্য যেসব ব্যাংকে অনিয়ম ও লুটপাট তার সাথে জড়িত মূল হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। একটি দেশের ব্যাংকিং খাতে যখন এমন অরাজকতা বিদ্যমান থাকে, তখন ব্যাংকের উপর সে দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়া স্বাভাবিক। তারা কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে না রেখে ঘরে রেখে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। যাদের সক্ষমতা রয়েছে তারা অর্থ পাচার করে হোক বা বিনিয়োগ করে হোক দেশের বাইরে নিয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে অর্থমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যকবার অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন, তিনি এ খাতটিকে কোন অবস্থায় রেখে যাচ্ছেন? তিনি যখন অবসরে যাবেন তখন এ চিন্তাটি করলে কী দেখবেন? অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা ছাড়া কি কিছু দেখতে পাবেন? আমরা মনে করি, দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জনসাধারণের আস্থা ধরে রাখার সুযোগ এখনও রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে ব্যাপক উদ্যোগ ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনআস্থা ফিরে আসবে। পাশাপাশি জনসাধারণ ব্যাংকের প্রতি আগ্রহী হয়, এমন সেবা বৃদ্ধি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন