জালাল উদ্দিন ওমর
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে পুকুরচুরি নয় বরং সাগরচুরি হয়েছে। সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সংসদে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী যখন ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা অতীব গুরুত্ব বহন করে এবং দেশবাসীকে ভাবিয়ে তোলে। কারণ ব্যাংক হচ্ছে জনগণের টাকা জমা রাখার একমাত্র বিশ^স্ত এবং আস্থার প্রতিষ্ঠান, যেখানে টাকা জমা রেখে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমায়। একই সাথে এই ব্যাংক হচ্ছে দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। স্বাভাবিকভাবেই যখন ব্যাংকে সাগরচুরি হয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়, তখন জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়। একইভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে যখন দুর্নীতি এবং চুরি হয়, তখন তার প্রভাবে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। অর্থনীতির গতি তখন ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে নি¤œমুখী হয়। সুতরাং দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতির স্বার্থেই ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি এবং চুরি বন্ধ করতে হবে।
ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অমূলক এবং অতিরঞ্জিত কিছুই নয়। এখানে তিনটি ঘটনার বর্ণনা করছি, যার ফলে এই সাগরচুরি সহজেই প্রমাণিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ফান্ড ট্রান্সফারের ৫টি আবেদনের মাধ্যমে এই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা এবং ফিলিপাইনে পাচার হয়। শ্রীলঙ্কায় পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ডলার এবং ফিলিপাইনে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। শ্রীলঙ্কায় পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। হ্যাকাররা তারবার্তার মাধ্যমে ওয়ারট্রান্সফার করে এই অর্থ চুরি করে। এই অর্থ চুরির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় আরো ৮৭ কোটি ডলারের চুরির ঘটনা বন্ধ করা গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফান্ড ট্রান্সফারের মোট ৩৫টি আবেদনের মধ্যে মাত্র ৫টি কার্যকর হওয়ায় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ডাকাতি হয়েছে। বাকি ৩০টি আবেদন কার্যকর হলে আরো ৮৭ কোটি ডলার ডাকাতি হতো। ফিলিপাইনের পত্রিকা ডেইলি ইনকোয়ারে সর্বপ্রথম এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর পর এদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। এ ধরনের রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশে^ এই প্রথম। ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক কর্পোরেশনের মাধ্যমে এই অর্থ চুরি হয়। ২০১৫ সালের মে মাসে এই ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ভুয়া তথ্য এবং আইডি ব্যবহার করে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এই অর্থ চুরির প্রক্রিয়ায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের সাথে মেইনটেইন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ফান্ড ট্রান্সফার হয়ে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক কর্পোরেশনের এসব অ্যাকাউন্টে জমা হয়। নিউইয়র্কের ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক এবং উইলস ফারগোর মাধ্যমে এসব অর্থ ট্রান্সফার হয়। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয় এবং ক্যাসিনোতে বিনিয়োগ হয়। পরবর্তীতে ক্যাসিনো থেকে সেই অর্থ তুলে নেওয়া হয় এবং অন্যত্র পাচার করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহার করে এবং সুইফট বার্তার মাধ্যমে এই অর্থ ট্রান্সফার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম, নাজনীন সুলতানা এবং ব্যাংকিং বিভাগের সচিব আসলাম আলমকেও অব্যাহতি দেয়। এর পর সরকার সাবেক সচিব ফজলে কবিরকে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। রিজাল ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ ব্যাংকিং নীতি লঙ্ঘন এবং জালিয়াতির অভিযোগে ২১ মার্চ জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দাগুইতো এবং উপব্যবস্থাপক অ্যাঞ্জেলা তোরেসকে সাময়িক বরখাস্ত করে। চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপাইনি ব্যবসায়ী কিম অং সিনেট কমিটির শুনানিতে এই অর্থচুরির বিস্তারিত বক্তব্য দেন এবং ৩১ মার্চ তিনি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দেন। ৪ এপ্রিল তিনি আরো ৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দেন। এভাবে মোট ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার ফেরত দেন। তবে এই টাকা বাংলাদেশ এখনো পায়নি। ৬ মে রিজাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী লরেঞ্জো তান এ ধরনের ঘটনা রোধে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ৩০ মে সরকারের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন। এতে তিনি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন এবং সুইফটকেও দায়ী করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫,৫৮৮ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলাপিং কান্ট্রিজ : ২০০৪-২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার , ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৬৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এসব অর্থ বাংলাদেশিরা বিদেশে পাচার করেছেন। যদি ১ ডলারের গড় মূল্য ৭৫ টাকা হিসাব করা হয়, তাহলে এ দশ বছরে পাচার হওয়া অর্থের বাংলাদেশি টাকায় পরিমাণ ৪,১৯,১০০ (চার লাখ উনিশ হাজার একশত) কোটি টাকা। আর শুধুমাত্র ২০১৩ সালে পাচারকৃত মুদ্রার বাংলাদেশি মান হচ্ছে ৭২,৫২৫ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি বছর পাচার হওয়া অর্থের বাংলাদেশি মান ৪১,৯১০ কোটি টাকা। জিএফআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার এবং অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পেনজারস এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী যেহেতু প্রতিবছরই অর্থ পাচার হয়েছে, সুতরাং অর্থ পাচারের এই ধারা ২০১৪-২০১৫ সালেও অব্যাহত ছিল এবং ২০১৬ সালেও অব্যাহত থাকাটা স্বাভাবিক। ২০১৪ সালের জুন মাসে ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং তার পরিমাণ প্রায় ৩ (তিন) লাখ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের চিত্রটি বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চ ২০১৬ শেষে এদেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১,০০,৬৪৮ কোটি টাকা আর একই সময়ে ব্যাংকগুলো কর্তৃক বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ৫,৯৮,৬৪৮ কোটি টাকা। মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৬.৮২% খেলাপি। এই প্রথমবার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। ডিসেম্বর ’১৫ স্থিতির তুলনায় এর পরিমাণ ৮০৪০ কোটি টাকা বেশি। তন্মধ্যে ৫৯,৪১১ কোটি টাকা ব্যালেন্সশিটে অন্তর্ভুক্ত আর রাইট অফ করা ৪১,২৩৭ কোটি টাকা, যা ব্যালেন্সশিটে অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০০৮ সালের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২২,৪৮১ কোটি টাকা আর রাইট অফ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫,৬৬৭ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮,১৪৮ কোটি টাকা। সেই ঋণ বেড়ে ২০১৬ সালের মার্চে এসে দাঁড়িয়েছে ১,০০,৬৪৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো প্রতিবছর বিশাল অংকের খেলাপি ঋণকে রাইটঅফ করে এবং তা ব্যালেন্সশিট থেকে বাদ দেয়। রাইট অফ করা ঋণ ব্যাল্যান্সশিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে না বিধায়, তা খেলাপি ঋণ হিসেবে ব্যাংকগুলো প্রকাশ করে না। তাছাড়া ব্যাংকগুলো আরো বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিসিডিউল করেছে, যা খেলাপি ঋণ হলেও রিসিডিউল করার কারণে আর খেলাপি ঋণে হিসাব করা হয়নি। ২০১৫ সালে বড় বড় শিল্প গ্রুপসমূহ ১৫০০০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে। রিসিডিউল এবং পুনর্গঠন করা ঋণ হিসাব করলে, এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। এই খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এবার উপর্যুক্ত বিষয় তিনটির একটি পোস্টমর্টেম করা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে হ্যাকিং বলা হলেও বাস্তবে এটি হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতি। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের সাথে যেখানে ২০০টির বেশি দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকের এবং বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাব রয়েছে, সেখানে চোরের দল বাংলাদেশকে কেন বেছে নিল সেটা বিরাট এক প্রশ্ন। একই সাথে চোরের দল বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব নম্বর, সুইফট কোড ও তার পাসওয়ার্ড কীভাবে জানল সেটাও বিরাট প্রশ্ন। ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ডলার ডেবিট হয়ে গেল, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিলেটেড ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা সেটা জানল না তা তো অসম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে যেখানে ইনস্ট্যান্ট সব তথ্য পাওয়া যায়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ব্যালেন্স ১০ কোটি ডলার কমে গেল, ব্যাপারটা তো সাথে সাথে জানার কথা। কিন্তু এত বিরাট ঘটনাটি প্রায় এক মাস পর্যন্ত প্রকাশিত হলো না। ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ ব্যালেন্সের ক্ষেত্রে গরমিল তো ধরা পড়ার কথা। ব্যাংকের প্রতিদিনের হিসাব নিকাশ এবং বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স নিয়ে ডেইলি পজিশন তৈরি করা হয়, যাতে একনজরে ব্যাংকের টোটাল চিত্র প্রতিফলিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ডলারের চুরির ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানল না! টোটালি ইম্পজিবল ম্যাটার। স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, এটা কিছু ব্যক্তির কারসাজির ফল। মূলত এখানে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কর্তৃক পরিকল্পিত ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে।
অন্যদিকে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে, তার সাথে কিন্তু সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিরাই জড়িত। দেশের গরিব মানুষেরা কখনো বিদেশে টাকা পাচার করে না। তাদের যেমন অর্থ নেই, ঠিক তেমনি অর্থ পাচার পথঘাটও তারা চিনেন না। রাজনীতিবিদ, বড় বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি, যাদের কাছে দেশবাসী ভালো কিছুই প্রত্যাশা করে তারাই আজ অর্থ পাচারের সাথে জড়িত। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ উন্নত দেশে পাচার করছেন। সেখানে বাড়ি কিনছেন, গাড়ি কিনছেন এবং অন্যান্য সম্পত্তি কিনছেন। সেখানেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছেন। ফলে আমাদের অর্থে অন্যান্য দেশ উন্নত হচ্ছে। এই অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে আমদানি-রপ্তানিতে মূল্য কারসাজি এবং এর শতকরা হার প্রায় ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ বিদেশে পাচারকৃত অর্থের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলকে ব্যবহার করেই পাচার হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং করেন অর্থাৎ পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থটা বিদেশে পাচার করেন। আবার পণ্য রপ্তানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং করে অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে রপ্তানি পণ্যের মূল্যের একটি অংশ বিদেশেই রেখে দেন। এভাবে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে এদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচার করার কারণে অনেক ঋণ গ্রহীতা ঠিকমতো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
গ্রাহক যখন ঋণের টাকা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করেন না, তখন তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় তো হয়ই না, অধিকন্তু মূল টাকাটাই গ্রাহকের হাতে আটকে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায় এবং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতা। খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর গতিকে পুরোপুরি আটকে রাখে। কারণ এই বিশাল পরিমাণ টাকা থেকে একদিকে ব্যাংক যেমন কোনো প্রকার আয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি এই ঋণ অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা নতুন করে অন্য কোনো সেক্টরে বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যায়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং ব্যাংকের আর্থিক গতিশীলতাও কমে যায়। ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। অপরদিকে এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হয় বিধায়, ব্যাংকের আয়ের বিশাল একটি অংশ খেলাপি ঋণের ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হয়। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের ডিপোজিটররা তাদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এসব টাকা এদেশের কোটি কোটি শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ। বাংলাদেশে আজ যত টাকা খেলাপি ঋণ আছে, তা যদি খেলাপি না হতো, তাহলে শুধুমাত্র এই টাকা দিয়ে দেশে হাজারো স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেত।
উপর্যুক্ত তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণের পর ব্যাংকিং খাতে সাগরচুরির বিষয়ে নিশ্চয়ই কারো দ্বিমত থাকবে না। আর সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকে হরিলুট তো সবারই জানা। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে অনেক ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব ঋণ কেলেঙ্কারির সাথে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ, ব্যাংকের অনেক পরিচালক এবং ব্যাংকের অনেক বড় কর্মকর্তা যে জড়িত সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ব্যাংক হচ্ছে বিশ^ব্যাপী আর্থিক নিরাপত্তা এবং বিশ^স্ততার প্রতীক। মানুষের অর্থ ব্যাংক যথাযথভাবে হেফাজত করে এবং চাহিবা মাত্র সেই অর্থ ব্যাংক আবার মালিককে ফেরত দেয়। এটাই ব্যাংকিং ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি এবং মূল চাবিকাঠি। তাই বিশ^জুড়ে দেশে দেশে শত কোটি মানুষ তাদের অর্জিত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে জমা রাখেন। আর চোরের দল এই ব্যাংক ডাকাতির জন্য সবর্দা লিপ্ত। অশিক্ষিত চোরের দল ব্যাংকের দারোয়ানকে খুন করে, ব্যাংকের তালা ভেঙে, ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুট করলেও, আধুনিক শিক্ষিত এবং দক্ষ চোরের দল প্রযুক্তির সাহায্যে এবং ঋণের নামে এখন ব্যাংকের টাকা লুট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা ডাকাতি, প্রতি বছর গড়ে ৪০,০০০ কোটি টাকা পাচার এবং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্ট ১,০০,০০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণÑ সবই দেশের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাই করেছেন। এসবই তো সাগরচুরি। সুতরাং জাতি হিসেবে আমাদের অধঃপতন কোনো পর্যায়ে এবং আমরা ধ্বংসের কোন লেভেলে ধাবিত হচ্ছি তা সবারই ভাবা উচিত। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিণতি ভোগ করব আমি আপনি সবাই এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন