বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

হাওরে মানবিক বিপর্যয় ও নানা শংকার কথকতা

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ
সমগ্র হাওর এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।  সে সাথে তলিয়ে গেছে হাওরবাসীদের সারা বছরের ভরসা ধান ও জীবনের সব স্বস্তি। গোটা হাওর এলাকায় নেমে এসেছে আকস্মিক মহাবিপর্যয়। সবগুলো হাওর ভেসে যাওয়ার পর বাকি ছিল সুনামগঞ্জের শনির হাওর ও পাকনা হাওর। যথাক্রমে রোববার ও সোমবার সকালে সে দু’টি হাওরও পানিতে ভেসে গেছে। এখন বিপন্ন হাওরবাসীদের চোখে সব হারানোর শূন্যতা আর বুক থেকে উঠে আসছে অনিশ্চয়তার দীর্ঘশ^াস। শেষ সম্বল গবাদিপশুগুলো এখন তারা বিক্রি করছে অর্ধেক দামে। সংসার চালানোর দুশ্চিন্তার সাথে যোগ হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিওগুলোর কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের চিন্তা। অনেক মানুষ পরিবারকে রক্ষার জন্য কাজ করে দু’টি টাকা পাওয়ার আশায় এলাকা ছেড়েছে। একদিকে এ প্রাকৃতিক বিপর্যয় অন্যদিকে হাওর এলাকার এক বিরাট অংশের মানুষের জন্য নেমে এসেছে আরেক অভিশাপÑ তা হলো মাছসহ জলজপ্রাণি ও হাঁসের ভয়াবহ মড়ক। আগে যা কখনো হয়নি, কেউ যা জীবনে দেখেনি এবারের ঢলের পানিতে সেই মাছসহ জলজপ্রাণি মরার ঘটনা ঘটেছে। সেই মরা মাছ খেয়ে মারা গেছে বহু খামারির হাঁস। এলাকার লোকজনসহ অনেকের ধারণা, পাশর্^বর্তী মেঘালয় রাজ্যে ইউরেনিয়াম আহরণের উন্মুক্ত পিট বৃষ্টির পানিতে ভেসে গিয়ে সেই ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি ঢলের সাথে হাওরে এসে এ মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে।  মানুষের মধ্যে এ নিয়ে শংকা ছড়িয়ে পড়ার পাশাপশি এ মড়কের প্রকৃত কারণ নির্ণয়ের জোর দাবি উঠেছে।    
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিত্য সাথী। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা, অনাবৃষ্টি বা খরা, ঢলের পানিতে ফসল ভেসে যাওয়া প্রায় প্রতি বছরের ঘটনা। আগে নদী অববাহিকায় আকস্মিক বন্যায় বা অতি বন্যায় ব্যাপক ফসল হানি ঘটত। এখন নদীগুলোর প্রাণ শুকিয়ে যাওয়ায় সে রকম ক্ষতি সংঘটিত হওয়া বন্ধ হয়েছে। হাওর এলাকায় ঢলের পানিতে একমাত্র ফসল ধান তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। বৃষ্টির পানিতে নামে এই ঢল। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলবীবাজার জেলার হাওরগুলো ভারত সীমান্তে বা সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকার কাছে সমতলে অবস্থিত। তাই বর্ষণের মাত্রা বেশি হলেই তা ঢলের আকারে নেমে এসে হাওর ভাসিয়ে দেয়। ক্রূর নিয়তি যেমন মানুষের সুবিধা-অসুবিধা দেখে না, এ পাহাড়ি ঢলও তাই।  বহু শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে চাষ করা সারা বছরের সম্বল ধান মুহূর্তের মধ্যে অথৈ পানিতে ডুবিয়ে দেয়। অসহায় মানুষ তাকিয়ে দেখে তাদের এ সর্বনাশ। প্রকৃতির রুদ্র রোষের সামনে তাদের কিছু করার থাকে না। তবে বাঁধ তৈরি করে এ ঢল রোধ করা হয়তো অনেকটাই সম্ভব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার হয়তো এগিয়েও আসে। কিন্তু স্বার্থের দ্ব›দ্ব আর সীমাহীন দুর্নীতির কারণে চাষীদের পক্ষে এর সুফল পাওয়া তেমন একটা হয়ে ওঠে না।
প্রতি বছরের মত এবারও হাওর এলাকার চাষীরা বোরো ধান রোপণ করেছিলেন বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে। সব জায়গাতেই ভালো ধান হয়েছিল। অনেকেই ফসল চাষের জন্য এনজিও ও ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ফসলের সম্ভবনাও ছিল আশাপ্রদ। কিন্তু অসময়ে নামা ঢলে তাদের জমির ধান তলিয়ে গেছে। জানা যায়, গত মাসের ২৯ তারিখে ঢলে প্রথম ডুবে যায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হাকালুকি হাওর ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। তারপর থেকে হাওরগুলো  একের পর এক তলিয়ে যেতে থাকে এবং সর্বশেষ শনির হাওর ও পাকনা হাওর তলিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়। ২৫ এপ্রিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক কেউ বলেছেন ৫ হাজার কোটি টাকা, কেউ আবার ১০ হাজার কোটি টাকা বলেছেন।
ইতোমধ্যে সরকার তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী হাওর এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করার এবং সবাই যেন ত্রাণ পায় সে জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার  ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও ৫শ’ করে টাকা দেয়ার পাশাপাশি স¦ল্পমূল্যে চাল ও আটা দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। পরবর্তী ফসল না ওঠা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক বছর এ সহায়তা কর্মসূচি চলমান থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ের খবরে জানা যায় যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা যেখানে প্রায় ২৪ লাখ সেখানে এ সহায়তা একেবারেই অপ্রতুল। এও জানা গেছে যে স্বল্পমূল্যের চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষকে প্রচন্ড দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরকার দুর্গত মানুষদের কাছে সহজে এ সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানা যায়নি। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ১১টি উপজেলা সদরে সীমিত আকারে খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে  গ্রামের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী ত্রাণ সহযোগিতার বাইরে রয়েছেন। অন্যদিকে উপজেলা সদরে চাল ও আটা কিনতে আসা অনেকেই সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করার পর খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।  হাকালুকি হাওর পারের কৃষক ইদই মিয়া বলেন, এমনিতেই কৃষি কাজের আয় দিয়ে ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু এ বছর এক মুঠো ধান ঘরে তুলতে পারিনি। কীভাবে বাচ্চাদের খাওয়াব এবং সংসার চালাবো চিন্তা করে কুলকিনারা পাচ্ছি না। আরেক কৃষক রাজনগর উপজেলার আব্দুল্লাহ বলেন, বোরো ধানের আয় দিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু এখন ঘরে ধানও নেই, গ্রামে কাজও নেই। বদরপুর গ্রামের কৃষক আমির আলী বলেন, সর্বশেষ সম্বল হালের বলদও গো খাদ্যের অভাবে অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছি। সরকার বলছে কাউকে না খেয়ে মরতে দেবে না। কিন্তু সময়মত চাল না পেলে তো বাঁচার আশা দেখি না।
একদিকে মানুষের মধ্যে যখন এ সারা বছরের ফসল হারিয়ে দুরবস্থার শেষ নেই অন্যদিকে হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওরে মড়কে মাছ ও হাঁসের মৃত্যুর বিষয় হাওর এলাকা তো বটেই, সারা দেশের মানুষকেও ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমাদের মিডিয়ার একটি অংশ এ ব্যাপারে দায়সারা ভূমিকা পালন করলেও সর্বস্তরের দেশপ্রেমী মানুষকে এ ঘটনা প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত মাসের একেবারে শেষে ভারত থেকে আসা ঢলের পানিতে হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর তলিয়ে যায়। ফলে উভয় হাওর এলাকার সব ধান পানিতে ডুবে গেছে। ফসল হারানোর শোকে দিশেহারা হয়ে পড়ে মানুষ। এ অবস্থায় তাদের আশার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় হাওরের মাছ। হাওর এলাকা মোটামুটি ছয়মাস থাকে পানির তলায়, বাকি ছয় মাস শুষ্ক। পানি আসার পর মাছ ধরেই হাওর এলাকার বেশিরভাগ মানুষের সংসার চলে। কিন্তু এবার তাদের সে আশাও বিলীন হয়ে গেছে। এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায় যে বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ধান ডুবে যাওয়ার দু’ সপ্তাহ পর ১৫ এপ্রিল প্রবল ঝড় হয়। পরে বাতাসের সাথে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকেই মাছের মড়ক দেখা যায়। তারা জানান, পোনা মাছ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, বোয়াল, গলদা চিংড়ি, পাবদাসহ দেশীয় সকল প্রজাতির মাছ মরে হাওরে ভাসতে থাকে। শুধু মাছই নয়, অন্যান্য জলজ প্রাণিও মারা গেছে। সেগুলো খেয়ে মারা গেছে খামারিদের বহু হাঁস। ফলে মাথায় হাত উঠেছে তাদেরও। মারা যাওয়া হাঁসের সংখ্যা ৩৮৪৪টি। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব মতে, ১২৭৬ টন মাছ মারা গেছে যার মূল্য ৪১ কোটি টাকা।  সংবাদ মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মৎস্য অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তারা সেখানে চুন ও জিওলাইট ছড়ান। বলা হয় যে ধান পচে পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে।  
হাওরে জলজপ্রাণির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার মৎস্য অধিদফতরের একটি দল পরিদর্শনে গিয়ে পানিতে বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি দেখতে পান যা জলজ প্রাণিদের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তবে কীভাবে এই পানি বিষাক্ত হয়েছে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রতিনিধিদলও এদিন হাওর পরিদর্শন করেন। তারা বলেছেন, অকাল বন্যায় হাওরের ধান ও ঘাস পচে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এতেই মরেছে হাঁস।
তবে হাওর এলাকার বাসিন্দারা এটি মানতে নারাজ। তারা জানান, এর আগেও এভাবে অকাল বন্যায় হাওরে পানি এসেছে; কিন্তু এভাবে মাছ মরতে দেখা যায়নি। উজানের পানিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক বিষক্রিয়া আছে কিনা তা দ্রæত পরীক্ষা করে দেখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছেন হাওর পারের মানুষ।
সাধারণ বিবেচনা মতে, হাওরে পানিতে ডুবে ধান পচলে এমন দুর্গন্ধ হওয়ার কথা নয়। এমন নয় যে হাওরের ধানের তুলনায় পানির পরিমাণ কম। বস্তুত হাওরে এত বিপুল পরিমাণ পানি যে ধান পচে সারা হাওর দূষিত বা দুর্গন্ধ হয়ে ওঠা অসম্ভবই বটে। তাছাড়া হাওরের পানি আটকা পড়া বা বদ্ধ পানি নয়। উল্লেখ্য, দেশের বহু এলাকায় পাট চাষ হয়। এ পাট কাটার পর তা পচানোর জন্য বদ্ধ পানিতে জাগ দেয়া হয়। পাট যেখানে জাগ দেয়া হয় সেখানকার পানি কালো ও গন্ধ হয়ে যায় এবং আশপাশে তা ছড়িয়ে পড়ে। ধান ডুবে গেলে তা গন্ধ ছড়াতে পারে যদি তা বদ্ধস্থান ও কম পানি হয়। বিশাল হাওরে বিপুল পরিমাণ পানির মধ্যে ধান পচে পানি বিষাক্ত হওয়ার কথা নয়।
অবস্থাদৃষ্টে কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করেন যে পানিতে ইউরেনিয়ামের প্রভাবই এই বিষক্রিয়ার আসল কারণ। এ ইউরেনিয়াম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি থেকে বৃষ্টির পানির সাথে নির্গত। সেটা পরিকল্পিত কিংবা দুর্ঘটনাগত কারণ থেকে হতে পারে।  এদিকে দেশের একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে সুনামগঞ্জের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে মেঘালয়ের ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি অবস্থিত। প্রবল বর্ষণের কারণে সৃষ্ট ঢলে সেই পিট থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি এসে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা ব্যক্ত করেছেন। খবরে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে রানিকোর মেঘালয় সীমান্তে ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড ইউরেনিয়াম আকরিক আহরণ করে। উন্মুক্ত এই ইউরেনিয়াম খনি  থেকে নানাভাবেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে থাকে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের ছাত্র সংগঠন ১৯৯২ সাল থেকেই এ ইউরেনিয়াম আহরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদেই কোনো কাজ হয়নি। এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সিলেট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, হাওর অঞ্চলে জলজপ্রাণিদের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর সাথে বিষয়টির (ইউরেনিয়ামের) সংযোগ থাকতে পারে।
হাওরে পানি দূষণ, দুর্গন্ধ, মাছ ও হাঁস মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল রোববার হাওর এলাকা পরিদর্শন করে। তাদের উদ্যোগে দূষিত পানি, মাটি, বালু, মরে যাওয়া মাছ, হাঁস ও জলজ উদ্ভিদের নমুনা ঢাকায় তাদের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। হাওরের পানিদূষণের কারণ কাঁচা ধানগাছ পচে যাওয়া নাকি অন্য কিছু? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ভৌতবিজ্ঞান বিভাগের সদস্য ড. দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ইউরেনিয়ামের কারণে হাওরে পানি দূষণ হয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য কমিশনের রসায়ন বিভাগের প্রধান ড. বিলকিস আরা বেগম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভারত থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি আমাদের হাওরগুলোতে আসার সম্ভাবনা অনেক। আর যদি তাই ঘটে তাহলে তা আমাদের জন্য অনেক বিপদজনক হবে। তবে তা পরীক্ষা করে বলা ভালো বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ হাওরের এমন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বলেন, এ বছর মার্চ মাসের আগাম বৃষ্টির কারণে হাওর অঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আগাম বন্যা দেখা দেয়। আগাম বন্যায় হাওর অঞ্চলের ধানখেত তলিয়ে যাওয়ায় কাঁচা ধানগাছ ও ধানের থোড়ে পচন ধরে। এতে হাওরের পানি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে পড়ে এবং এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাওরে মাছের মড়ক দেখা দেয়। তবে পানিতে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। জমিতে কীটনাশক ছিটানোর কারণে পানি দূষিত হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।
হাওরে মাছসহ জলজপ্রাণির মড়ক লাগার ৩টি কারণ শনাক্ত করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। হাওরের বিভিন্ন স্থানের গত শুক্রবার পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস ও অ¤øীয় মাত্রার পরিমাণ অধিক। পানিতে প্রাণের অস্তিত্বত্ব টিকে থাকার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকার প্রয়োজন তা হাওরে নেই। এছাড়া সহনীয় মাত্রার চেয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস ও অ¤েøর পরিমাণও অনেক বেশি। তবে ঠিক কী কারণে পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস ও অ¤øীয় মাত্রার পরিমাণ অধিক হলো বা অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেল তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কর্মকর্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলও বিভিন্ন হাওর ঘুরে পানি পরীক্ষা করেন। তিনি বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কিছু নেই। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এদিকে সোমবার  মন্ত্রিসভার অনির্ধারিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরের পানিতে ইউরেনিয়ামের কথা নাকচ করে দিয়ে এটাকে বিএনপির অপপ্রচার বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যম বিষয়টি প্রমাণের আহবান জানান। হাওরে মৃত মাছের পরিসংখ্যান নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, এ বৈঠকে হাওর এলাকায় পানিতে ইউরেনিয়াম ও মাছের মৃত্যুর বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলে তো ভালো, ইউরেনিয়াম অনেক দামি, এটা সংগ্রহ করা যেতে পারে- এ বলে মন্ত্রীরা বৈঠকে হাসাহাসি করেন।
হাওরে হঠাৎ অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ধান ডুবে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে মাছসহ জলজ প্রাণি ও হাঁসের মড়ক। খেলো যুক্তি দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।  এক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম দূষণের যে মারাত্মক আশংকা বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে তা কোনোমতেই উপেক্ষা করার বিষয় নয়। জাতির স্বার্থে এর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন,  দেশের প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং জাতিসংঘ এগিয়ে আসতে পারে। মানুষ বড়, অন্য আর কিছু নয়Ñ এ মহামন্ত্রে সত্যের প্রকাশ নিশ্চিত হোক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন