গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল : আমরা বাংলাদেশি। আমাদের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের অতি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। হাজার হাজার বছরের প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে আমাদের বাংলাদেশের। এ রকম প্রাচীন ও সুস্পষ্ট ইতিহাস অন্য কোনো দেশের আছে বলে মনে হয় না। “বাঙালির ইতিহাস” গ্রন্থে ড. মোহাম্মদ হান্নান, গোলাম হোসায়ন সলীম জইদ পুরীর ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’ বই হতে ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। রিয়াজ-উস-সালাতিন গ্রন্থখানি রচিত হয় (১৭৬৮-১৭৮৮ খ্রি.)। গ্রন্থটিতে বঙ্গ নামের মুসলিম চিন্তা-চেতনা ও বাঙালি মুসলমানদের প্রাচীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ (আ.), তার স্ত্রী, সন্তানসহ ৮০ জন নর-নারী আল্লাহর হুকুমে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বংশ বৃদ্ধিতে নিয়োজিত থাকেন। নূহ (আ.) এর পরবর্তী বংশধরগণই নতুনভাবে পৃথিবী সাজিয়েছেন। নূহ (আ.)-এর এক পুত্র হাম এশিয়া অঞ্চলে বংশ বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। হামের পুত্র “হিন্দের” নামানুসারে হিন্দুস্থান, সিন্দের নামানুসারে ‘হিন্দুস্থান’ বা ‘সিন্দু’ এবং হিন্দের পুত্র ‘বঙ্গ’-এর নামানুসারে বঙ্গদেশ। বঙ্গদেশের বা বঙ্গের সন্তানেরা বাঙালি বা বাংলাদেশি হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করে। তা হলে বলতে আর বাধা নেই নূহ (আ.)-এর পৌত্র বা নাতির নামানুসারে বঙ্গ বা বাংলাদেশ। এ ভ‚খÐের অধিবাসীরা বাংলাদেশি বা বাঙালি।
আবার অনেকে মনে করেন, বঙ্গ নামের উৎপত্তিতে ‘বংশী’ ও ‘বাঙালি নদীর’ ইতিহাস উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। প্রাচীন যুগেই বাংলা মূলত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। গুপ্ত শাসনের পতন হলে ৫৫১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলা এলাকা নিয়ে বঙ্গ-সমতট রাজ্য ও বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গৌড় নামে আলাদা রাজ্য গড়ে ওঠে। সেই যে ৫৫১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ রাজ্য দুভাগে বিভক্ত হল সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছরেও বাংলা এক হতে পারেনি। ভবিষ্যতে বাংলা একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলার পশ্চিমাংশ এখন (১৯৪৭ হতে) ভারতের অন্তর্গত। বঙ্গের পূর্বাংশ ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। এই প্রাচীন বঙ্গজাতির ইতিহাস সংস্কৃতি ও সভ্যতা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। তবে প্রতœতত্ত¡বিদ ও ঐতিহাসিকদের ধারণা এখন থেকে ১০,০০০ বছর আগে বাংলাদেশে সভ্যতার সূচনা ঘটে। বাংলার এ সভ্যতার নাম ‘গঙ্গা রিদি সভ্যতা’। পদ্মা বা গঙ্গা নদীর তীরে এ সভ্যতার সূচনা ঘটে। গ্রিক ঐতিহাসিকগণ বাংলাকে গঙ্গারিদয় বা গঙ্গারিদি বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক টলেমি ও পেরিপ্লাস গ্রিক ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন, গঙ্গা রিদি রাজার বাসস্থান ছিল ‘গঙ্গে’ তবে গঙ্গারিদি রাজার রাজধানী গঙ্গে কোথায় অবস্থিত ছিল তা কিন্তু গ্রিক লেখকগণ উল্লেখ করেননি। তবে বাংলাদেশের ঐতিহাসিকদের ধারণা খুলনার কুমার নদীর তীরে ‘গঙ্গে’ বা গঙ্গারিদি রাজার বাসস্থান ছিল।
বর্তমান সুন্দরবনের হরিণ ঘাটাকে গঙ্গে বলে কল্পনা করা হয়। গ্রিক ইতিহাসে ‘গঙ্গে’-ই বাংলা সভ্যতার শুরুর কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুরের কালিগঙ্গা নদীর পশ্চিমতীরে এবং পদ্মা বা গঙ্গা নদীর পূর্বতীরে ‘গঙ্গানগর’ নামে একটি প্রাচীন নগরের অবস্থান বিক্রমপুরের মানচিত্রে সার্ভেয়ার জেনারেল এফআরএস দেখিয়েছেন। পদ্মার দিক পরিবর্তনে নগরটি বিলীন হয়ে গেছে। প্রাচীন বাংলায় স্বর্ণের খনি ছিল বলেও গ্রিক ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন বাংলায় বা বর্তমান বাংলাদেশে কোন সোনার খনি নেই। তবে প্রাচীন বাংলার বিক্রমপুরে সোনারং, স্বর্ণ গ্রাম, সোনারগাঁও, সোনাকান্দ এখনো বিদ্যমান। মহারাজ চৈতন্য গুপ্ত (৫০৭-৫০৮ খ্রি.) পূর্ব বাংলা অঞ্চল শাসন করতেন। তিনি বাংলায় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। এছাড়া সমাচার দেব নামক বাংলার আরো একজন রাজা স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। বাংলাদেশে যদি স্বর্ণের খনি না থাকতো তা হলে এতো স্বর্ণমুদ্রা কীভাবে তৈরি হতো। প্রাচীনকালে বাংলার কোথাও হয়তো স্বর্ণের খনি ছিল। আমাদের সভ্যতার ইতিহাস প্রাচীন ও রোমঞ্চকর। আরসি মজুমদার ভারতের প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে বোলপুরের কাছে পান্ডু বাজার ঢিবি খনন করে বাংলার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেই প্রাচীন যুগে বাঙালিরা লোহা ও তামার ব্যবহার জানতো।
বাঙালিরা সেই প্রাচীন যুগে লিখতেও পারতো তাও ঢিবি থেকে আবিষ্কৃৃত হয়েছে। ঢিবি খননের পর পাকা রাস্তাও পাওয়া গেছে। এ সভ্যতার প্রকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে। নোয়াখালী জেলায় যে উৎকীর্ণ লিপি উদ্ধার করা হয়েছে তা থেকে অনুমিত হয় যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এ বাংলাদেশের মানুষ ‘প্রাকৃত’ ও ‘ব্রা²ী’ লিপিতে বিদ্যাচর্চা করত। ঐতিহাসিক রামশরন শর্মা বগুড়া জেলা হতে বেশ কিছু লিখন পদ্ধতির নমুনার কথা “প্রাচী ভারত’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ সকল লিখন পদ্ধতি স¤্রাট অশোকের রাজত্ব কালের। সিলেট জেলার ভাটেরা গ্রামে গোবিন্দ কেশব দেবের শাসনামলের একটি লিখিত শিলালিপি উদ্ধার হয়েছে। নিহার রঞ্জন রায় এ লিপিটি প্রাচীন বাংলার অন্যতম লিখিত প্রমাণ বলে উল্লেখ করছেন। ভারতের উত্তর প্রদেশে কৌশাম্বীর নিকট পভেসার প্রাপ্ত একটি গুহালিপিতে অধিচ্ছত্রের রাজা “বঙ্গপাল” বলে উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গপালের পুত্র আসারসেন প্রথম শতাব্দিতে এ গুহালিপিটি করিয়েছিলেন। সামরিক দিক দিয়েও প্রাচীন বাংলার মানুষ খুবই শক্তিশালী ছিল। গ্রিক ইতিহাস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক ঐতিহাসিকরা বাঙালিদের যোদ্ধা জাতি হিসেবে অবহিত করেছেন। আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন গঙ্গারিদি রাজা তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলাকে রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
আলেকজান্ডার ৩২৫-৩২৬ খ্রিস্টাপূর্বে মোট ১৯ মাস ভারত আক্রমণ চালান। গঙ্গারিদি রাজা আলেকজান্ডারকে বাধা দিতে দিতে ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ২ লাখ পদাতিক, ৮,০০০ রথ, ৬০০০ যুদ্ধ হস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু মহামতি আলেকজান্ডার বাংলায় না এসে বিপাশা নদী তীর থেকে ব্যবলিনে ফিরে যান। চন্দ্রগুপ্ত নামে এক বাঙালির সাথে পাঞ্জাবে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এখন থেকে ১০,০০০ বছর আগের ‘প্যালিওথিক ও মাইক্রোলিথিক’ অস্ত্র পশ্চিম বঙ্গে পাওয়া গেছে। তা থেকে আর অপেক্ষা থাকে না প্রাচীন কালে বাংলাদেশ কত শক্তিশালী ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-৬০০ অব্দ পর্যন্ত বাংলার নিজস্ব সভ্যতার সাথে আর্যসভ্যতার দ্ব›দ্ব বাঁধে। তাই হয়তো মহাভারতের যুদ্ধে বঙ্গরাজ চিত্রসেন, পুন্ডুরাজ-বাসুদেব, প্রাকজ্যোতিষ-পুরাধিকনরক, মগধরাজ-জরাসন্দ কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এ হলো আমাদের প্রাচীনকালের গর্বিত ইতিহাস। আমাদের প্রাচীন সেই সভ্যতার নির্দশন বিক্রমপুর, গৌড়, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, সোনরাগাঁও, পান্ডুয়া এখনো কালের সাক্ষী হয়ে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে দু’ভাগ হয়ে যায়। হিন্দু বিশেষ এলাকা পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাথে চলে যায়। আর মুসলমান আধিক্য এলাকা পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ঢাকা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন