আল ফাতাহ মামুন
কয়েকদিন থেকেই বুকের বা দিকে মৃদু ব্যথা অনুভব করছেন। হঠাৎ ব্যথা বেড়ে যাওয়ার বাসার মানুষ ধরাধরি করে আপনাকে হাসপাতাল ভর্তি করাল। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, হৃদযস্ত্রে বøকের পরিমাণ প্রায় নব্বই শতাংশ। জরুরি ভিত্তিতে রিং না পরালে বড় ধরনের বিপদ এমনিকি মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে। চিকিৎসকের এমন কথায় প্রভাবিত হয়ে আপনার আমার মতো কতজনই না লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে ভালো হার্টে রিং পরিয়ে বসে আছেন। অন্য সবার মতো ভুল করলেন না কাওলা দক্ষিণখানের বাসিন্দা কামরুজ্জামান কামরুল। রাজধানী উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং লুবানা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা ‘ইমিডিয়েটলি’ হৃদযন্ত্রে রিং পরাতে বললে তার স্বজনরা খরচ কত হবে জানতে চান। সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখের মতো লাগবে জেনে হতভম্ব হয়ে যান রোগীর স্বজনরা। তারা রিং পরাতে না চাওয়ায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা যা তা ব্যবহার শুরু করে স্বজনদের সঙ্গে। রোগীসহ তারা শিফট হন শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। এনজিওগ্রাম রিপোর্ট দেখে সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক এম আক্তার আলী বলেন, এত সামন্য পরিমাণ বøকের জন্য হার্টে রিং পরানোর প্রয়োজন নেই। পরে ওই দুই হাসপাতালের অসাধু ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান। গত মাসের ২২ তারিখ দৈনিক বণিক বার্তা প্রথম পাতায় খবরটি প্রকাশ করে।
একদিক থেকে কামরুজ্জামানকে ভাগ্যবান মানতেই হবে। গেল মঙ্গলবারের বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারি, অনেক রোগীদের না জানিয়েই হার্টে রিং স্থাপন করানো হচ্ছে। স্বজনদের জিজ্ঞেসেরও প্রয়োজন মনে করছেন না কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। চিকিৎসা শেষে লাখ টাকার বিল দেখে চোখ কপালে ওঠে স্বজনদের। কিছু বললে চিকিৎসকরা জানান, অবস্থা সিরিয়াস ছিল। তাই আপনাদের মতামত নিতে পারেনি। এক কথার ওপর দু’ কথা বলতে গেলেই রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে অকথ্য গালাগাল ও নির্মম ব্যবহার শুরু করে দেন কতৃপক্ষ। এভাবেই রোগী ও স্বজনদের জিম্মী মুখে হৃদযন্ত্রে রিং স্থাপনের নাম করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। আমাদের দেশের ক’জনই বা কামরুজ্জামানে মতো সচেতন? আর সচেতন হলেও দু’ দু’টো হাসপাতালের ডাক্তারদের কথা উপেক্ষা করে তৃতীয় হাসপাতালে গিয়ে চেকআপ করানোর মানসিকতা কতজনই বা লালন করেন?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, হার্টে রিং পরানোর এত তোরজোর কেন ডাক্তারদের পক্ষ থেকে। উত্তর খুব সহজ। একটি রিং বাবদ অনায়েসেই দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব। তাইতো প্রয়োজন না থাকলেও রিং বসিয়ে দিচ্ছেন আপনার আমার হৃদযন্ত্রে। শুধু কি তাই? মেয়াদত্তীর্ণ রিংও স্থাপন করা হচ্ছে হৃদযন্ত্রে। এতে লাভের টাকা দিগুণ হয়ে যায় এক পলকেই। তাই হার্টে রিং বসানোর ক্ষেত্রে ভালো করে যাচাই বাছাই না করলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে আপনার। তাই এ ব্যাপারে একটু বেশি সচেতনতাই কাম্য।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন আপনার বা আপনজনের হৃদযন্ত্রে রিং বসাতে হবে। এক্ষেত্রেও চোখ কান খোলা না রাখলে লস গুনতে হবে লাখ টাকা। গেল শুক্রবার দৈনিক জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে থেকে জানাযায়, মাত্র ১৮ হাজার টাকার রিং সিন্ডিকেটের কারণে রোগাীর হার্টে বসাতে গুনতে হয় এক থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। আর অন্যান্য পত্রিকা থেকে জানায় ২৮ থেকে ৩১ হাজার টাকায় রিং কিনে তা বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়। এটা সরকারি হাসপাতালের খরচ। আর বেসরকারি হাসপাতালে ওই রিং-ই বিক্রি হয় দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায়। মানুষের জীবন বাঁচানি ‘রিং’ একদল অতি মুনাফাখোরদের কারণে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আরেকদল অসাধু চিকিৎসক এ নিয়ে সাধারণ মানুষকে ফেলছে জিম্মির মুখে। রিং পরানো দরকার না হলেও পরিয়ে দিচ্ছেন যার-তার হৃদযন্ত্রে। আর এতেই রোগীর জীবনে নেমে আসে অস্বাভাবিক অবস্থা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত হার্টের ৭০ শতাংশ বøক হলে রিং পরানো জরুরি হয়ে পড়ে। কখনো কখনো ৫০শতাংশ বøক হলেও রিং পরানোর প্রয়োজন হতে পারে। এর কম বøক হলে বা প্রয়োজন নেই এমন হার্টে রিং পরানো হলে মানব দেহে নানান জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তাই হার্টে রিং পরাতে হলে ভেবে চিন্তে, হার্টের বøকমাত্রা মেনে তারপর রিং বসানোর পরামর্শ দিয়েছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা।
হার্টের রিং নিয়ে রমরমা বাণিজ্য বন্ধ করতে সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সর্বনিম্ম ২০ হাজার ৪০৯ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯১ টাকায় রিং পাবেন রোগীরা। কোন রিংয়ের দাম কত তা চার্ট আকারে রোগীদের নজরে আসে এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয় হাসপাতাল কতৃপক্ষদের। কিন্তু গত সোমবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমন কোন চার্ট নজরে পড়েনি সাধারণ রোগী ও সংবাদকর্মীদের। মঙ্গলবার বিভিন্ন কাগজে এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওঠে আসে রোগীদের বক্তব্য। আসাদ নামে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক রোগীর স্বজন জানান, শুনেছিলাম মূল্য তালিকা টানানোর কথা কিন্তু রিসেপশন, বহির্বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার ও হাসপাতাল অফিসের কোথাও কোনো তালিকা খুঁজে পাইনি। রবিবার একই হাসপাতালে অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয় জান্নাতুল ফেরদৌস মাওয়া নামে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া রেলস্টেশন সংলগ্ন। তার বাবা আকমল হোসেন জানান, গত কয়েক বছর ধরে তার মেয়ের হৃদরোগের সমস্যা ছিল। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারেননি। মেয়ের হার্ট অপারেশনে রিংয়ের মূল্য তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। সব খরচ মিলে তা দেড় লাখে যেতে পারে। ওই রিং বাইয়ো কার্ড লিমিটেডের সেলস এক্সিকিউটিভ মো. নুরুল আমিন শিপনের কাছ থেকে নিয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে শিপন রিং বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন তারা হার্টের ভাল্ব সরবরাহ করেন।
হার্টের রিং এর মূল্য তালিকা নেই এবং নির্ধারিত দামের বেশি মূল্যে রিং বিক্রিয় করা হলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে- এ সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে করোনারি স্ট্যান্ট কিংবা হার্টের রিংয়ের মূল্য ঠিক করেছি। সব হাসপাতাল তা এখন অনুসরণ করবে। যারা করবে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ১৫টি আমদানিকারকের ৩৭টি ব্র্যান্ডের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি।’
হার্টের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে মানুষ যেন আর হয়রানি না হয় এ আমাদের চরম চাওয়া। প্রতিটি হাসপাতাল নির্ধারিত মূল্যেই রোগীদের সেবা দিবেন। সিন্ডিকেট মুক্ত রিং মানুষের জন্য আরো সজহ লভ্য হোক। আর অতি মুনাফার লোভে ভালো হার্টে যেন রিং না বসে- এ আমাদের পরম প্রতাশ্যা। ভালো থাকুক হার্ট, ভালো থাকুন আপনিও- খোদার কাছে এ আমাদের প্রার্থনা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
alfatahmamun@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন